আনন্দদায়ক শিক্ষা
ওমর আব্দুল আজিজ তালুকদার
জানি আমার এই লেখাটি অনেক বোরিং হবে, এমনিতেই সবাই আমাকে বোরিং ভাবে, এই লেখার দ্বারা অনেকেরই সেই ধারণাটা স্থায়ী বিশ্বাসে রূপ নিবে। তারপরেও লিখে ফেললাম, কারণ আমার লেখার বিষয়বস্তু যদি আমরা শিক্ষকরা মেনে চলতে পারি তাহলে আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের ক্লাস করাটা আনন্দদায়ক হবে। সেটাই আমার আসল চাওয়া। পত্রিকা প্রকাশের সময় প্রতি বছরই ভাবি এইবারে কিছু লেখা দিব। কিন্তু, প্রথমত প্রচণ্ড ব্যস্ততা, দ্বিতীয়ত লিখতে গেলেই মনে হয় এটা লিখলে সবাই আরও বিরক্ত হবে। এমনিতেই আমি সবাইকে অনেক বিরক্ত করি, থাক না হয় সেটা আর না বাড়ালাম। কিন্তু এইবার কেন জানিনা মন থেকেই খুব ফিল করছি লেখাটা প্রকাশ করা দরকার। তাই শুধুমাত্র লেখাটা শেষ করবো বলেই কর্মক্ষেত্রের বাহিরে গিয়ে দুই দিন ছুটি নিয়ে লেখাটা শেষ করলাম।
যাই হোক যদিও আমার এই লেখাটা প্রাথমিক ভাবে মনে হবে শুধুমাত্র শিক্ষকদের জন্য কিন্তু আমি চাই শিক্ষক – শিক্ষার্থী উভয়েই পড়ে সেই অনুযায়ী চেষ্টা করুক, যাতে করে আমাদের শিক্ষাদান আরও ফলদায়ক হয়। অভিভাবকগণ বলেন, শিক্ষকদের কথা শিক্ষার্থীরা বাবা-মার চেয়ে বেশি শোনে, গুরুত্ব দেয়। সেই জন্য অনেক অভিভাবকই আমাকে বিভিন্ন অনুরোধ করেন যেটা আমি গুরুত্বের সাথে নিয়ে ব্যবস্থা নিই। কিন্তু আজ একটা কথা প্রকাশ করে দিচ্ছি, আমরা শিক্ষকরাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আবদার-অনুরোধ মেনে নেই। তো আমি চাই আমাদের শিক্ষার্থীরাও সচেতন হোক এবং সঠিক শিক্ষাদান কিভাবে হওয়া উচিত সেটা অনুধাবন করুক।
পাঠটি আনন্দদায়ক করে পড়াতে হবেঃ আমি যত নিয়োগ দিয়েছি (ওমর কিন্ডারগার্টেন স্কুল এন্ড ওমর গার্টেন একাডেমি) সবাইকে একটা কমন প্রশ্ন করি, শিক্ষাটা কিভাবে আনন্দদায়ক করা যায়? প্রায় সবাই একই উত্তর দেয় যে – এমন ভাবে পড়াতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা আনন্দ পায়… আমি বলি সেটাই তো জানতে চাই কিভাবে পড়াতে হবে… তখন উত্তর আসে – বিভিন্ন মজার গল্প শোনাতে হবে, জোকস শোনানো যায়, গান-কবিতা বলা যায়, আমি বললাম হয় নি। আমি জানতে চাই আপনি যে পড়াটা পড়াবেন মনে করেন “পরিবেশ কাকে বলে” এটা পড়াবেন তো এই পরিবেশ এর সংজ্ঞাটা কিভাবে আনন্দদায়ক করে পড়ানো যায়। যেই পড়াটা শিক্ষার্থীদের শেখাবেন সেই শেখানোটা অবশ্যই আনন্দদায়ক হতে হবে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন আউট নলেজ দেওয়া যায়, গল্প, গান, কবিতা হতে পারে কিন্তু আমি যেটা পড়াবো সেই পড়ানোটা যদি আনন্দদায়ক না হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের শিখনটা ভালো হবে না। তাই শিক্ষার্থীদের শিখনটা আনন্দদায়ক হবে, আকর্ষণীয় হবে নিম্নোক্ত বিষয় গুলোসহ ক্লাসে গেলে :
১। পরিপূর্ণ ক্লাসের প্রস্তুতি ( অধ্যায় ভিত্তিক বাস্তবমূখী, এক্সেপশনাল প্রশ্নতালিকা, হ্যান্ডনোটসহ)
২। প্রেজেন্টেশন এর মাধ্যমে ক্লাস নেয়া।
৩। উক্ত অধ্যায়ের উপরে ইউটিউব থেকে খুঁজে খুঁজে ভিডিও বের করে সেগুলো ক্লাসে দেখানো, যেমন মুক্তিযুদ্ধের উপরে পড়ানোর সময় আমি যতই বলি আমাদের জনগণ রক্ত দিয়ে, জান দিয়ে যুদ্ধ করেছে, পাক বাহিনী প্রচুর হত্যা করেছে সেটা সেই ভাবে অনুধাবন হবে না কিন্তু সেটা যদি আমি ভিডিও আকারে ঐ দৃশ্য গুলো ক্লাসে দেখাই সবাই সহজেই বুঝতে পারবে যে আমাদের স্বাধীনতাটা অর্জন করা কতো কঠিন ছিল। এছাড়াও প্রতিটি শিক্ষককে তাঁর নিজের রেকর্ড করা কিছু ভিডিও থাকতে হবে, সেটা প্রাথমিক ধারণামূলক হতে পারে। যেগুলো ক্লাসে পড়ানোর সময়ে দেখানো হবে।
৪। বাস্তব উদাহরণ, বাস্তব উপকরণ, মডেল ইত্যাদি নিয়ে ক্লাস করানো। আমি নিজে যখন সপ্তম/অষ্টম শ্রেণিতে বীজগণিত করতাম। তখন শুধু বার বার মনে হতো, এটা কেন করছি? এটা তো মনে হয় কোন কাজেই আসবে না! পাটিগণিত একটু আধটু হয়তো মানুষের জীবনে কাজে লাগবে… বীজগণিত কোন কাজেই আসবে না। কিন্তু ঐ সময় আমাদের শিক্ষক বীজগণিত করানোর আগে যদি সেটার ইতিহাস, বাস্তবে কোথায় কোথায় কাজে লাগবে সেটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিত হয়তো গণিত আমি আরও বেশি বেশি করতাম। শুধু এতটুকু বলি আমাদের বর্তমান আধুনিক বিশ্ব, মহাকাশ, রকেট সব জায়গায়ই বীজগণিত লাগে। কোনো অজানা কিছু বের করার দরকার হলে, আগে সেটাকে এক্স ধরে নিয়ে এগানো হয় । ফলে সহজেই সমাধানে আসা যায়। যাই হোক, গণিতের শিক্ষক এই ব্যাপারে আমার চেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।
৫। প্রয়োজন মত পোস্টার, চার্ট, ব্যানার, আর্ট পেপার ইত্যাদি ব্যবহার করা। আমরা সবাই জানি যেকোনো জিনিস বুঝাতে গেলে সেটা যদি দেখানো যায় সেটা অনেক সহজেই বোঝা যায়। আর এগুলোর জন্য যতো খরচ হবে সবই প্রতিষ্ঠান বহন করবে, কোন শিক্ষককেই একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না।
৬। ফ্ল্যাশ কার্ড, ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং- প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে বা মাঝামাঝি এমন একটা টপিক এর উপরে লিখতে বলা যেটা শিক্ষার্থীরা চিন্তাভাবনা করে বানিয়ে লিখবে। ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশে খুব সহায়ক।
৭। ব্যবহারিক অথবা আউটডোর ক্লাস নেওয়া। মাসে, দু’মাসে একবার হলেও শিক্ষার্থীদের আউটডোর ক্লাস নেওয়া উচিত। এতে শিক্ষার্থীদের মাইন্ড ফ্রেশ হয়। আর ব্যবহারিক ক্লাসের গুরুত্ব আসলে বলে শেষ করা যাবে না। আর ব্যবহারিক বলতে শুধু নবম-দশম না, তৃতীয় শ্রেণির বিজ্ঞান ক্লাস থেকে শুরু করে ষষ্ঠ বা সপ্তম, অষ্টম সকল ক্লাসের বিজ্ঞানের ক্লাসগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যবহারিক ক্লাস নেওয়া দরকার। শুধু বিজ্ঞান নয়, কৃষি সহ বেশ কিছু বিষয়েই ব্যবহারিক ক্লাস নিতে হবে।
প্রশ্ন করতে দেওয়াঃ ক্লাসটা দ্রুতই বোরিং হয়ে যাবে যদি না আমি ক্লাসে প্রশ্ন করতে দেই। তাদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করতে হবে। ওই টপিক এর উপরে আনকমন প্রশ্ন করাতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে ওই আনকমন প্রশ্নের উপরে ক্লাসে গ্রুপ ভিত্তিক যুক্তি/তর্ক অনুষ্ঠানও করা উচিত।
১০ মিনিট পড়ানো তারপর ১০ মিনিট অনুশীলন: এটা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত একটানা ১০-১৫ মিনিটের পরের লেকচারগুলোতে শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগই গ্রহণ করতে পারে না। আর যখনই শিক্ষক লম্বা সময় লেকচার দিবেন তখন পিছনে কিছু শিক্ষার্থী দুষ্টামি করবে। কারণ তারা বোরিং ফিল করছে। সুতরাং দ্রুতই লেকচার বন্ধ করে সেই টপিক এর উপরে লিখতে দিতে হবে। এখানে মূল কথা হচ্ছে খণ্ড খণ্ড করে বুঝানো এবং ঐ খণ্ডের উপরে লেখানো। তাহলে সেটা শিক্ষার্থীদের কাছে আনন্দদায়ক হবে।
বোঝানোর ক্লাসের তুলনায় অনুশীলনের ক্লাস জরুরী বেশিঃ কিছু কিছু ক্লাস নিতে হবে যেখানে কোনো বোঝানো বা লেকচার হবে না, ক্লাসের পুরো সময় জুড়ে প্রচুর এক্সারসাইজ করাতে হবে। কিছু শিক্ষার্থী বলতে পারে স্যার বুঝিনি আবারো বুঝান, সেক্ষেত্রে তাকে বলতে হবে তুমি আগে লেখা শুরু করো কোন জায়গায় বোঝনি বা কোথায় আটকে গেলে আমি বুঝিয়ে দিব। কারণটা হচ্ছে যতই বোঝানো হোক শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে না করতে দিলে কোনো ভাবেই কনফিউশন দূর হবে না। একবার কোনো টপিক বুঝে গেলে তখন শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে আনন্দ পাবে। ক্লাস পলায়নের পিছনে মূল কারণই হচ্ছে ওই ক্লাস শিক্ষার্থীর বুঝে আসে না। না বুঝলে আমরা যদি সিনেমাও দেখতে দেই সেখানেও মানুষ ঘুমাবে।
কুইজ যেকোনো পাঠকেই সহজে আয়ত্তে নিতে সাহায্য করেঃ প্রতিটি অধ্যায় শেষে গ্রুপ ভিত্তিতে ঐ অধ্যায়ের উপরে কুইজ করাতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে শেখার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করার আগ্রহ তৈরি হবে। আমাদের প্রতিটি ক্লাসেই ৩/৪ টি গ্রুপ করে দিয়েছি, গ্রুপ লিডার করে দিয়েছি। এই উদ্দেশ্যেই যেন, এখানে গ্রুপ কুইজসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা গ্রুপ ভিত্তিতে করাতে পারি। এই গ্রুপ গুলোতে বিজয়ীদের পুরস্কারের কথাও বলা হয়েছে।
উপরের ৭ টি কাজ করলে শিক্ষাদান আনন্দদায়ক হতে বাধ্য। কিন্তু, ইট ইজ ইজি টু সে বাট ডিফিকাল্ট টু ডু। এইজন্য আমরা শিক্ষকদের উপরের টপিক এর উপরে প্রতি মাসে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচন করে পুরস্কার দেই। দিনে দিনে এগুলো যত ভালো হবে পুরস্কারের অংক, পরিমাণও তত বাড়বে। আমি খুব আশাবাদী দিনে দিনে এটা আরও ভালো ভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবো। একটা ব্যাপারে আমার বলতে কোনো দ্বিধা নেই আমাদের শিক্ষকগণ অনেক পরিশ্রম করেন, আমার অনেক কঠিন নির্দেশনা তারা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেন, আমি সত্যিই গর্বিত আমার এই নিবেদিত শিক্ষক বাহিনী নিয়ে। আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়েও আমি অনেক গর্বিত, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি এদের যোগ্য নই, আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড মেধাবী। তারা আমাদের মাঝে আছে বলেই আজ আমরা বড়াই করি, তারা আছে বলেই আমাদের প্রতিষ্ঠানটি আজ এত সুন্দর। আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে, তাদের ত্যাগ, পরিশ্রম নিয়ে হয়তো কোন একদিন লিখবো…..
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।