শনিবার , ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - বর্ষাকাল || ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু ও তাহার অজানা কিছু স্মৃতি

প্রকাশিত হয়েছে- বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু ও
তাহার অজানা কিছু স্মৃতি

মোঃ মহসিন রহমান
স্টাফ রিপোর্টার।

গত রবিবার ২২ শে অক্টোবর, ২০২৩ইং তারিখ বীরমুক্তিযোদ্ধা জনাব অলি মাষ্টার সাহেব নিজ বাড়ীতে মৃত্যু বরন করেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-লিল্লাহি রাজিউন।
জাতির শ্রেষ্ঠ্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধকালীন সময়ে ছিলেন সেকশান কমান্ডার ও হাতিরদিয়া হাইস্কুলের সাবেক শিক্ষক জনাব মোঃ ওয়ালিউল্লাহ মোল্লা ( অলি মাষ্টার) সাহেবের বীরত্বগাঁথা।
★দৌলতপুর ইউনিয়নের, কোচের চর গ্রামের কৃতী সন্তান জনাব অলি মাষ্টার বিএসসি সাহেব। উনি কোচের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে, চাদপুর ডি এন হাইস্কুল থেকে ১৯৬২ সালে মেট্রোকুলেশন পাশ করেন। চাদপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে ১৯৬৪ এইচ এস সি পাশ করেন। আনন্দমোহন ডিগ্রি কলেজ ময়মনসিংহ থেকে ১৯৬৬ সালে বি এস সি ( ডিগ্রি) পাশ করেন।
★জনাব অলি মাষ্টার সাহেব, বি এস সি শেষে ১৯৬৬ সালে হাতিরদিয়া ছাদত আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছুসময় শিক্ষকতা করেন। উনি পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে বাউয়ানি জুট মিল ডেমরা, সুপার ভাইজার হিসাবে চাকুরীতে যোগদান করেন। তারপর ইউনাইটেড জুট মিল, নরসিংদীতে শিফট ইনচার্জ হিসাবে যোগদান করেন।
★জুট মিলে চাকুরীরত অবস্হায় যুদ্ধের ঘোষনা আসায়, এই বীর ১৯৭১ সালে ১লা জুন ঢাকা থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ভারতে যাওয়ার পথে অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে, আগরতলা কংগ্রেস ভবনে উপস্হিত হোন। কংগ্রেস ভবনে পুর্বে থেকে অপেক্ষমান তখনকার সময়ের নরসিংদী -৪ আসনের এম পি মহোদয় জনাব মরহুম গাজী ফজলুর রহমান সাহেবের সাথে উনার দেখা হয়। মাননীয় এম পি সাহেব কিছু লিফলেট দিয়ে উনার সাথে আসা ১০/১২জনকে দেশে পাঠিয়ে দেন। তারপর উনি দেশে চলে আসেন এবং যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
★ জনাব অলি মাষ্টার সাহেব, দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে এই অকুতোভয় সৈনিক, আবার ১৯৭১সালের জুলাই মাসের ২৮ তারিখে ট্রেনিংএর উদ্দেশ্যে আবারো ভারতে রওনা হোন। উনি আখাউড়া কোনাবন হয়ে হাফানীয়া ইয়ুথ ক্যাম্পে ১লা আগষ্টে পৌছেন। ঐ ক্যাম্পের ডেপুটি ক্যাম্প চীফ ছিলেন, উনার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী বন্ধু জনাব এম এ সাত্তার সাহেব ( হাওয়া চেয়ারম্যানের ছোট ভাই) এর সহযোগীতায়, ঐদিনই ট্রেইনিংয়ের জন্য রিক্রুট হয়ে লেম্বুছড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগদান করেন। বি কোম্পানিতে অস্ত্রচালানোর ট্রেনিং শেষে সেকশন কমান্ডার হিসাবে নিজ থানায় চলে আসেন।
★৭ই অক্টোবর,১৯৭১ সাল দশদোনা যুদ্ধ ইপিআর বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর সাথে সশস্র অবস্হায় প্রচন্ড গুলাগুলি হয় পাকিস্হানী আর্মির সাথে, ওখানে জনাব অলি মাষ্টার সাহেব সেকশান কমান্ডার হিসাবে উনার বাহিনী অংশগ্রহন করেন। ঐ যুদ্ধে পাকিস্হানী আর্মীর দুইজন সদস্য আটক করেন, পরে তাদের কে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
★এই অকুতোভয় বীরমুক্তিযোদ্ধা, ২০ শে অক্টোবর, ১৯৭১ সাল বিলগাীর ফাইট, ইপিয়ার বাহিনী সাথে মুক্তি বাহিনীর ৪৮ গ্রুপের ৬টা সেকশানের সবাই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ৬টা সেকশনের কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন বীরমুক্তিযোদ্ধা নরসিংদী ৪ এর তৎকালীন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক বেলাবরের কৃতীসন্তান জনাব আবেদ উদ্দিন আহমেদ। এযুদ্ধে জনাব অলিমাষ্টার সাহেব সেকসান কমান্ডার হিসাবে নেতৃত্ব দেন এবং ১২টা গ্রেনেট বসানোর কাজ উনি ও উনার দলবল সুদক্ষ হাতে মাটির নীচে স্হাপন করেছিলেন। পাকিস্তান আর্মির গাড়ী আসার সাথে সাথেই ১২টা গ্রেনেট বিস্ফোরিত হয়েছিল কিন্তু দুটো গাড়ী অলৌকিক ভাবে রক্ষা পায়।
এখানে বাংকারে অবস্থান নিয়েছিল ইপিআার বাহিনীর সদস্যরা ভারী অস্ত্র নিয়ে, গ্রেনেট বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথেই পাকিস্তান আর্মীর গাড়ী লক্ষ্য করে গুলি বর্ষন করতে থাকেন, তখন আর্মির গাড়ী দুটো উল্টে যায়। এখানে বিশেষ ভাবে স্বরনীয় তৎকালীন ইপিআর সদস্য নোয়াদিয়ার কৃতীসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মজিবুর মাষ্টার সাহেব ( হাতিরদিয়া হাইস্কুলের করনীক) সাহেবের কথা। চৌকস এ সদস্য এল এম জি হাতে নিয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করেন। উনি অস্ত্র চালানোতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। এসব যুদ্ধ করার কারন হানাদার বাহিনীদের জানান দেওয়া মুক্তি বাহিনীর সরব উপস্থিতি আছে সর্বত্র।
★মনোহরদী থানা মুক্ত করার জন্য থানায় নিয়োজিত সকল সেকশনের কমান্ডার সহ সবাই, যার যার এলাকা অনুযায়ী, হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিলো। ইপিআর বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা মনোহরদী থানা হানাদার বাহিনী মুক্ত করার জন্য সবাই বিশেষ অবদান রোখেছিলেন। মনোহরদী মুক্ত করার জন্য, জনাব অলি মাষ্টার সাহেব ও উনার দলবল মনোহরদী থানা মুক্ত করার জন্য সশরীরে উপস্থিত ছিলেন।
★বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনাব অলি মাষ্টার নিজ কর্মস্থলে ফিরে যান পরবর্তীতে উনি প্লাস্টিক ফ্যাক্টরী চালু করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে নরসিংদী- ৪ এর সাবেক সাংসদ গাজী ফজলুর রহমান সাহেবের দুঃখজনক মৃত্যুর পর, জনাব অলি মাষ্টার সাহেবকে হত্যা মামলার অন্যতম আসামি করা হয়। হত্যা মামলায় উনি গ্রেফতার হন, একজন অলি মাষ্টারের জীবনের চলমান ভবিষ্যত থেমে গেছে আটকের পর। মাষ্টার সাহেব গ্রেফতার হওয়ার পর অনিশ্চিত ভবিষ্যত দেখে উনার সহধর্মিণী অন্যত্র বিয়ে করেন আর এখবরটি উনি পেয়েছিলেন জেলখানায় বসে। জীবনে এঘটনায় উনি অনেক মনব্যথা পেয়েছিলেন। মিথ্যা মামলা প্রমানিত হওয়ায় জেল থেকে বের হলেন ঠিকই কিন্তু উনি জীবনের পথচলায় সঠিক সীদ্ধান্তটা নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন কারন উনার আত্মসন্মানে আঘাত করেছিল উনার প্রথম স্ত্রী। পরবর্তীতে উনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন বরিশালে ও এই সহধর্মিনীই মাষ্টারের জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সুখ দুঃখের সাথী। এভাবেই একজন উজ্জ্বল নক্ষত্রের চলমান জীবনের উত্থান পতনের গল্প তৈরী হয়েছিল। উনি জীবনে চলেছেন অত্যন্ত সাবলীল ও সুন্দর পথে আত্মসন্মানের সাথে।

★ শ্রদ্ধ্যাচিত্তে স্বরনকরি, জনাব অলি মাষ্টার সাহেবকে। উনাদের মত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। জনাব অলি মাষ্টার সাহেবের মৃত্যুতে গভীর শো।