আধুনিক বিশ্বে অর্থ লেনদেনের বড় মাধ্যম ব্যাংক। আর ব্যাংক লেনদেনের প্রায় গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত চেক। কিন্তু উদ্বেগজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ইদানীং চেক ডিজঅনারের ঘটনা, চেক হারিয়ে যাওয়া এবং চেক নিয়ে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বহুলাংশেই বেড়েছে। ডিজঅনার হওয়া চেকের বাহক অ্যাকাউন্টধারী নিজে হলে সেটা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে, অ্যাকাউন্টধারী অন্য কাউকে চেক লিখে দিলেন এবং সেটি ব্যাংকে প্রত্যাখ্যাত হলো, তবে সেটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পর্যাপ্ত টাকা না থাকার কারণে চেক ডিজঅনার হলেই কেবল অ্যাকাউন্টধারীর বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। সাধারণত আদালতে চেক ডিজঅনার- সংক্রান্ত মামলা দায়ের করা হয় ‘হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১’-এর অধীনে। এক্ষেত্রে একজন ভুক্তভোগীর আইনি করণীয় কী হতে পারে?
যেসব কারণে চেক ডিজঅনার হতে পারে:
ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা তোলার অন্যতম মাধ্যম চেক। সেই চেক
গ্রাহক বা অন্য কেউ ব্যাংকে দেওয়ার পর ব্যাংক চেকে উল্লেখিত অঙ্কের নগদ টাকা দেয়। নগদ টাকা ছাড়াও ক্রস চেক বা অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক হলে প্রাপকের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়। পরে গ্রাহক টাকা তুলে নিতে পারেন। আধুনিককালের ক্রেডিট কার্ড এবং ক্যাশ কার্ডকেও চেকের একটি বিশেষরূপ বলা যায়। চেকে উল্লিখিত অঙ্কের টাকা অ্যাকাউন্টে না থাকলে ব্যাংকের পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব হয় না এবং চেক প্রত্যাখ্যান করা হয়, যা চেক ডিজঅনার হওয়া নামে পরিচিত। এ ধরনের চেককে বলা হয় ‘বাউন্সড চেক’। যেসব কারণে চেক ডিজঅনার হতে পারে, সেগুলোর উল্লেখ করে একটি ছাপানো রসিদ প্রতিটি ব্যাংকে থাকে। যে কারণে চেকটি প্রত্যাখ্যাত হলো তা চিহ্নিত করে ওই স্লিপসহ চেকটি প্রাপকের কাছে ব্যাংক ফেরত পাঠায়। নিম্নলিখিত কারণে চেক ডিজঅনার হতে পারে-
১.অপর্যাপ্ত ব্যাংক তহবিল,
২.অঙ্কে ও কথায় গরমিল,
৩.চেকে তারিখ ঠিকমতো না লেখা,
৪.প্রদানকারী কর্তৃক পরিশোধ বন্ধ করা,
৫. প্রদানকারীর স্বাক্ষর জাল করলে,
৬. যথাযথ ব্যাংকের শাখায় উপস্থাপন না করলে,
৭. স্টপ পেইমেন্ট কিংবা অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকলে,
৮. চেক ইস্যুর ছয় মাসের মধ্যে ব্যাংকে জমা না দিলে।
মনে রাখতে হবে, শুধু অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে চেক প্রত্যাখ্যাত হলে তখনই হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১-এর ১৩৮, ১৪০ ও ১৪১ ধারায় মামলা করা যায়।
যেসব কারণে চেকের অমর্যাদা হতে পারে:
যেসব কারণে চেকের অমর্যাদা হতে পারে সেগুলো হচ্ছে-
১. চেক মেয়াদোত্তীর্ণ হলে,
২. যথাযথভাবে চেক পূরণ করা না হলে,
৩. চেকে ড্রয়ারে স্বাক্ষর না হলে,
8. চেক পোস্ট ডেটেড অর্থাৎ পর-তারিখের হলে,
৫. চেকে স্বাক্ষরের সঙ্গে ব্যাংকে রক্ষিত গ্রাহকের নমুনা স্বাক্ষরের অমিল হলে,
৬. চেকে উল্লিখিত টাকার পরিমাণ অংকে ও কথায় অমিল হলে,
৭. হিসাবে পর্যাপ্ত স্থিতি না থাকলে,
৮. চেকে ঘষামাজা থাকলে,
৯. চেকে কাটাকাটি থাকলে পূর্ণ স্বাক্ষর দিয়ে তা সত্যকরণ না করা হলে,
১০. ব্যাংকিং সময়ের পর চেক উপস্থাপন করা হলে।
কোনো প্রতিষ্ঠান জাল চেক দিলে:
হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন-এর ১৩৮ ধারায় বর্ণিত অপরাধ সংঘটনকারী যদি কোনো কোম্পানি হয় এবং ওই কোম্পানি যদি সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে ওই অপরাধ সংঘটনের সময় কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী হবেন এবং আইন অনুযায়ী দণ্ডিত হবেন। কোম্পানি/ফার্ম/অংশীদারি প্রতিষ্ঠানগুলো আইনের দৃষ্টিতে ‘ব্যক্তি’। সুতরাং যদি কোনো কোম্পানির মালিক, ব্যবস্থাপক অথবা কোনো প্রতিনিধি যদি কোম্পানির পক্ষে ভুয়া বা জাল চেক স্বাক্ষর করেন, সেই ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা যেমন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সচিব বা বিভাগীয় পরিচালক বা চেয়ারম্যানকে মামলায় আসামী করতে হয়। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৪০ ধারার বিধান অনুসারে কোম্পানি/ফার্মকে পক্ষ করা বাধ্যতামূলক এবং তা করা না হলে সেটি মামলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি হিসেবে বিবেচিত হবে, যার ফলে আসামীর খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কোম্পানির ক্ষেত্রে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারার পাশাপাশি ১৪০ ধারা উল্লেখ করে মামলা করতে হয়।
কে মামলা করতে পারেন:
এ ধরনের মামলা একজনের পক্ষে আরেকজন করতে পারেন না। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চেক দেয়া হয়েছে কেবল তিনিই মামলা করতে পারেন। মামলা করার ক্ষেত্রে তারিখ খুব গুরুত্বপূর্ণ, চেক ডিজঅনার হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে নোটিশ পাঠাতে হয়। আর ৩০ দিনের মধ্যে দাবি না জানালে সেটি আইনের দৃষ্টিতে গ্রাহ্য হয় না। নোটিশ পাঠিয়ে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এর পর ৩০ দিনের মধ্যে মামলা করতে হয়।
লেখক: মোঃ হাচিবুল হক (আইন বিভাগ শেষ বর্ষ), নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি,খুলনা।