মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ১৪ বছরে এই আইনের অধীনে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে করা প্রায় সব চুক্তিই বিতর্কিত। কোনো চুক্তিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়নি। প্রতিযোগিতাও ছিল না, যে কারণে এসব চুক্তিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। আর ভবিষ্যতে দুর্নীতির দায়ে যাতে কোনো কর্মকর্তাকে আইনের মুখোমুখি হতে না হয়, সে কারণে আইনের মাধ্যমে দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই আইন বাতিল করার কথা বলে আসছেন দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, ২০১০ সালে জরুরি সংকট মোকাবিলায় প্রচলিত আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি এবং অপর্যাপ্ততা নিরসন সময়সাপেক্ষ হওয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। গত ১৪ বছরে ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের দেশে পরিণত হয়। স্থাপিত ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি দাঁড়িয়েছে। কিন্তু উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের দেশ হলেও লোডশেডিংমুক্ত হয়নি।
খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরুরি সংকটের সময় বিশেষ আইন করা হয়েছিল দুই বছরের জন্য। কিন্তু আইনটি এখনো বলবৎ। এখন তো জরুরি সংকট নেই। বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির পরও দীর্ঘদিন ধরে এ আইনটি রাখা হয়েছে মূলত অনিয়ম ও দুর্নীতি করতে। সরকারঘনিষ্ঠ ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে এই আইন। এটি দ্রুত বাতিল করা দরকার। এতে সরকারের ওপর থেকে বাড়তি ব্যয়ের চাপ কমবে। সাধারণ মানুষও স্বস্তি পাবে।
আইনটির ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবোচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ উপশিরোনামে ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’
অর্থাৎ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট এবং এর ফলে জনদুর্ভোগের কারণে যদি কেউ দায়ী থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এমনকি কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি বা অসংগতি থাকলেও আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসব কারণে এটিকে ‘দায়মুক্তি’ আইন বলে অভিহিত করেন অনেকেই।
জ্বালানি খাতের বিশেষ ওই আইনের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি।’ বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী একক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি করার বিধান রয়েছে এ আইনে।
গ্যাস-বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ, অবকাঠামো নির্মাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অস্বচ্ছতার পাশাপাশি এসব চুক্তির ক্ষেত্রে অতি গোপনীয়তা রক্ষাও করে সরকার। প্রতিযোগিতা না থাকায় বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছামতো দাম আদায় করছে, যার ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। সর্বশেষ ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয়ের যে অসম চুক্তি হয়েছে, তা নিয়েও
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, এটি একটা সংবিধানবিরোধী আইন; কালো আইন। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এই আইন বাতিলের জন্য বলে আসছি। আইনটি এখনই বাতিল করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিশেষ আইন বাতিলের কোনো বিকল্প নেই। আইন বাতিল করে বড় বড় প্রকল্পের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা ফিরবে, ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত হবে।