মৌসুমের বাইরে আমের ঘাটতি মেটাচ্ছে কাটিমন
বিশেষ প্রতিনিধি আব্দুল মজিদ – কাটিমন আম পাকার পর হলুদ রঙের হয়।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ বাড়ছে কাটিমন নামের বারোমাসি আমের। দেশীয় আমের মৌসুমের বাইরে বছর জুড়ে এই আম উৎপাদিত হয় বলে স্থানীয় বাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পাইকারি পর্যায়েই প্রতি কেজি আম ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বছরে দুই বার তোলা যায় কাটিমন আম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায় কাটিমন আম বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে লাভবান হচ্ছেন অনেকেই।উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সলেহ আকরাম জানান, বর্তমানে সারা দেশেই এই আমের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি চাষ হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায়।
তিনি বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে পরীক্ষামূলক চাষে সফলতা পাওয়ার পর কাটিমন আম চাষ নিয়ে প্রচারণা চালানো হয়। দেশের বিভিন্ন হর্টিকালচার সেন্টারে এর চারা উৎপাদন করা হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন নার্সারির মাধ্যমে এই আম গাছ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
এই উপজেলার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম শিক্ষকতা পেশা বাদ দিয়ে কাটিমন আম চাষ শুরু করেন। কাটিমন আম গাছের সাতটি বাগান রয়েছে তার। সাথে মাছ আর গরুর খামারও করেছেন তিনি।
মি. ইসলাম জানান, পারিবারিকভাবে কৃষির সাথে জড়িত থাকার কারণেই কৃষির প্রতি ঝোঁক ছিল তার। আর সেই ঝোঁক থেকেই শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি আম চাষেই মনোনিবেশ করেছেন তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় তিনিই প্রথম কাটিমন আম চাষ শুরু করেন।
আট বছর আগে সাত বিঘা জমিতে কাটিমন আম চাষ শুরু করেন তিনি। এরপর তার আম বাগানের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে তার সাতটি বাগানে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজারের মতো আম গাছ রয়েছে। প্রতি বছর এই আম চাষ থেকে তার আয় লাখ টাকা।
কাটিমন আম কী?
নাচোল উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সলেহ আকরাম বলেন, কাটিমন আম আসলে থাইল্যান্ড থেকে আনা একটি প্রজাতি। একে সুইট কাটিমনও বলে।
এর স্বাদ ভালো, বেশ মিষ্টি হয়। এছাড়া আঁশ না থাকার কারণে এটির চাহিদা রয়েছে।
কৃষি বিভাগের আওতায় বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে প্রকল্প পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ আমের এই প্রজাতিটি প্রথম বাংলাদেশে নিয়ে আসেন।
কৃষি তথ্য সার্ভিসে একটি লেখায় তিনি এই আম সম্পর্কে বলেন, কাটিমন আমটিকে স্থানীয়ভাবে অমৃত নামেও ডাকা হয়। যেকোনও বারোমাসি আমের জাতের মধ্যে এটি আঁশহীন সেরা জাত।
কাটিমন আম গাছে ফেব্রুয়ারি, মে ও নভেম্বর মাসে মুকুল আসে এবং মার্চ-এপ্রিল, মে-জুন ও জুলাই-অগাস্ট মাসে আম পাকে।
তবে মে থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশীয় নানা জাতের আম থাকার কারণে ফেব্রুয়ারি মাসে মুকুল ভেঙ্গে দেয়া হয়।
থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে কাটিমন আম চাষ করা হয়। একই সঙ্গে এসব দেশ এই আম রপ্তানিও করে থাকে।
ফলন কেমন?
আম চাষী রফিকুল ইসলাম বলেন, বছরে দুই বার আমের ফলন পাওয়া যায় কাটিমন আম গাছ থেকে। একটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে, আরেকটি মার্চ মাসে।
“সেপ্টেম্বরে তো আমাদের যে দেশীয় আম রয়েছে সেগুলো শেষ হয়ে যায়। ওইটা শেষ হওয়ার পর এটা শুরু হয়।”
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ফলন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। তখন হেক্টর প্রতি ছয় থেকে সাত টন আম তোলা যায়।মার্চ-এপ্রিলের দিকে আমের ফলন কিছুটা কম হয়। সেই সময় হেক্টর প্রতি দুই থেকে তিন টন আম পাওয়া যায়।
উচ্চ ফলনশীল এই আমের প্রতিটির ওজন ৩০০ থেকে ৩৫০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই আম থোকায় থোকায় হয়। প্রতিটি থোকায় পাঁচ থেকে ছয়টি আম থাকে।
দাম কেমন?
আমচাষীরা বলছেন, বাজারে প্রতি মণ কাটিমন আম ছয় হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।
আমের মৌসুম থাকার সময় অর্থাৎ অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের দিকে যে ফলনটা পাওয়া যায় তার দাম কিছুটা কম। কারণ মৌসুমি দেশীয় আমের চাহিদাই তখন বেশি থাকে। তখন মণ প্রতি ছয় হাজার টাকা করে বিক্রি করেছেন কৃষকরা।
কিন্তু আমের মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার পর মার্চের দিকে ফলন কম হলেও দামটা বেশ ভালো পাওয়া যায়। কারণ তখন বাজারে আর অন্য কোনও আম থাকে না। ফলে প্রতি মণ কাটিমন আম ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
“সিজনের আমটা যখন শেষ হয়ে গেল, তখন ১২ হাজার ১৩ হাজার টাকা মণ পেলাম,” বলেন আম চাষী রফিকুল ইসলাম।
কৃষি কর্মকর্তা সলেহ আকরাম বলেন, আমের মৌসুমে দেশী জাতের আম চাষ করে অনেক কৃষক ক্ষতির মুখে পড়লেও কাটিমন আম চাষ করে ক্ষতির সম্ভাবনা কম।
কারণ আমের মৌসুমে ফলন প্রচুর হওয়ার কারণে অনেক সময় কৃষকরা আম বাজারজাত করতে সমস্যার মুখে পড়েন। কিন্তু কাটিমন মৌসুমের বাইরে হওয়ার কারণে এটি বাজারজাত করতে কোনও সমস্যা হয় না। উল্টো বেশ ভালো দাম পাওয়া যায়।
“অফ সিজনে আম চাষ করে তারা লোকাল মার্কেটে ২৫০ টাকা এবং ঢাকার মার্কেটে ৩০০ টাকা করে কেজি বিক্রি করতে পারছে।”
লাভজনক বিধায় কৃষকরা নতুন করে বাগান করার বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছে। রপ্তানিযোগ্য আম প্রকল্প এবং অন্য প্রকল্পের অধীনে চাষীদের নতুন বাগান করে দেয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন মি. আকরাম।
তাদেরকে চারা, কলম, রাসায়নিক ও জৈব সার সরবরাহ করা হচ্ছে। বাগানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
চাষ পদ্ধতি
কৃষি কর্মকর্তা সলেহ আকরাম বলেন, বাগান কেমন হবে তা মাটির অবস্থা, পানির উৎসের উপর নির্ভর করে।কেউ বাগান করতে চাইলে বিঘা প্রতি ৪০-৪৫ হাজার টাকা বাগান ব্যবস্থাপনা বাবদ খরচ হবে।
সাধারণত পলিযুক্ত বেলে দোআঁশ মাটিতে এই গাছ ভালো হয়। মাটির পিএইচ বা অ্যাসিডিটির মাত্রা ছয়-সাত থাকলে ফসল ভালো হয়।
মি. আকরাম বলেন, আম মূলত শুষ্ক আবহাওয়ার একটা ফসল। ফলে গরমের সময় তাপমাত্রা বেশি হতে হবে। আবার শীতের সময় শীতকালের ব্যাপ্তি বেশি হতে হবে এবং তাপমাত্রাও যথেষ্ট কম থাকতে হবে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে এই ধরণেরই আবহাওয়া ও পরিবেশ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
“এ কারণেই কাটিমন আমটা এখানে ভালো হচ্ছে এবং সুইটনেসটাও বেশি হচ্ছে।”
কৃষি কর্মকর্তা সলেহ আকরাম বলেন, বারোমাসি আমের মধ্যে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে উদ্ভাবিত বারি আম-১১ রয়েছে। তবে এই আমে অনেক বেশি আঁশ থাকার কারণে সেটি জনপ্রিয়তা পায়নি, এর মিষ্টতাও কম।
তিনি বলেন, কাটিমন আম যেহেতু বিদেশি প্রজাতি তাই এটি চাষে একটু বাড়তি যত্ন দরকার হয়। বিশেষ করে যখন মুকুল আসে তখন যাতে এটি ঝরে না পড়ে তার জন্য রুটিন মেনে বালাইনাশক ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। চারার দাম পড়ে গড়ে ১০০ টাকা করে।
কাটিমন আম চাষী রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি ঘন পদ্ধতিতে আম চাষ করে থাকেন। সে হিসেবে তার ৩৩ শতাংশ জমিতে ২৮০-৩০০টি গাছ লাগানো আছে। প্রতি ছয় ফুট বাই পাঁচ ফুট জায়গা পর পর একটি করে চারা লাগাতে হয়।
চারা লাগানোর দুই বছর পর থেকে ফলন পাওয়া শুরু হয়। একবার গাছ লাগানোর পর ২০ থেকে ৩০ বছর ফলন পাওয়া যায়।
মি. ইসলাম বলেন, “আমার কাছে তো ১২ বছর বয়সী গাছ আছে।”
তিনি বলেন, দেশী আম গাছের তুলনায় কাটিমন আম গাছের যত্ন বেশ আলাদা। মৌসুমের বাইরে যদি আম পেতে হয় তাহলে, আমের মৌসুমের সময় যে মুকুল বা গুটি আসে সেটি ভেঙ্গে দিতে হয়। একে বলা হয় প্রুনিং। এটা কাটিমন আম চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
“প্রুনিং না হলে অসময়ে কিন্তু আম পাবো না।”
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন আম গাছে মুকুল আসার সময়। এখন মুকুল আসলে সেটি এক মাস পরে কেটে দিতে হবে। এটাই প্রুনিং। নিয়মিত গাছে পানি ও খাবার দিতে হয়।
“এছাড়াও পুষ্টির যদি কোনও ঘাটতি থাকে, অণু খাদ্যগুলো যদি পরিপূর্ণভাবে না দেয়া যায়, তাহলে ওই গাছটাতে যথার্থ ফলন পাবো না।”