বুধবার , ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১৫ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

জাপান টোব্যাকো নষ্ট করছে লোহাগাড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ তামাক পাতা চাষে আকৃষ্ট হচ্ছে কৃষক

প্রকাশিত হয়েছে- মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৩

জাপান টোব্যাকো নষ্ট করছে লোহাগাড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ তামাক পাতা চাষে আকৃষ্ট হচ্ছে কৃষক

 

কামরুল ইসলাম চট্টগ্রাম

ধান চাষের তেকে দিনের পর দিন সরে যাচ্ছে লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজান ইউনিয়নের অধিকাংশ কৃষক কৃষকরা ধান চাষের ছেয়ে তামাক পাতা চাষের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে এর জন্য দায়ী জাপান টোব্যাকো তারা কৃষক কে তামাক পাতা চাষের দিকে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। স্থানীয় জনসাধারণ বলেন শুখনো মৌসুম পাতা পোড়ানোর দুর্গন্ধে লোহাগাড়ার আকাশ বারি হয়ে উঠে। জনসমাগম স্থলে তামাক পাতা পোড়ানো এবং বায়িং হাউজ করা আইন গত নিষেধ থাকলে ও এই আইন মেনে কাজ করছেন না লোহাগাড়ায় জাপান টোব্যাকোর ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত নজরুল এই বিষয়ে থাকে গাবতলি এলাকার স্থানীয় জনসাধারণ অভিযোগ করলেও তিনি কোন প্রকার ভুমিকা রাখছেন না এবং এই বিষয়ে লোহাগাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা( ইউএনও) মহোদয় এর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন এলাকাবাসী। তামাকের বিভিন্ন কুফল সম্পর্কে জানতে গিয়ে জানাযায়
কলাউজান ইউনিয়নের গাবতলি এলাকার বাসিন্দা মাওলানা বশিরুল ইসলাম। মাদ্রাসায় পড়ার সময় থেকে পাতা, জর্দা, গুলসহ তামাকের রাজ্যে বিচরণ শুরু তার। ৫৫ বছর বয়সে এসে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্থূলতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত তিনি। তবুও তামাকের নেশা ছাড়তে পারছেন না বলে জানাযায় ।
পরিবারিক সূত্রে জানা গেছে, এক মাস আগে তিনি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। এক সপ্তাহের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তামাকজাত দ্রব্যের বিষয়ে চিকিৎসকের কড়া নির্দেশনায় কিছুটা কমালেও পুরোপুরি ছাড়তে পারছেন তামাক সেবন কারিরা।
বশিরুল ইসলামের স্ত্রী সুফিয়া আক্তার বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মী কে বলেন, আমাদের পরিবারে দৈনিক ৪০ টাকার পান-সুপারির প্রয়োজন হয়। সেইসঙ্গে পাতা বা জর্দাও লাগে বেশ। প্রতি মাসে পান-জর্দার পেছনে খরচ হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। শুধু এখানেই শেষ নয়, হার্টের সমস্যা আর ডায়াবেটিস থেকে স্বামীর শরীরে এখন নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। এখন প্রতি মাসে তার পেছনে সাত থেকে আট হাজার টাকার ওষুধসহ চিকিৎসাবাবদ আরও ১০ হাজারেরও বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। চিকিৎসা বন্ধ করলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ অবস্থায় চিকিৎসার ব্যয় বহন করে সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
‘হার্ট অ্যাটাকের পর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অতিমাত্রায় পাতা-জর্দা সেবনের কারণে আজ তার এ অবস্থা। এখন ভয়ের কারণ, যদি দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক হয় তাহলে তাকে আর বাঁচানো যাবে না। ওনাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে কম খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে।’
এমন পরিস্থিতি শুধু বশিরুল ইসলামের নয়, সারাদেশের অসংখ্য মানুষ ও পরিবারের নিয়মিত চিত্র এটি। সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো বলছে, পাতা-জর্দাসহ তামাক সেবনে শুধু কিছু অর্থ নষ্ট হচ্ছে না, নীরবে-নিভৃতে একজন ব্যক্তি ও একটি পরিবারকেও নিঃস্ব করে দিচ্ছে তামাকে যত রাজস্ব, তার চেয়েও বেশি চিকিৎসা ব্যয়।
বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষেত্রে পানের সঙ্গে সাদা পাতা, আলা পাতা, জর্দা, মাড়িতে গুলের ব্যবহার বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের ফলে ফুসফুস ক্যান্সার, মুখ গহ্বরের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ (সিএপিডি), ডায়াবেটিস, হাঁপানি ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
তামাক নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক প্রকাশনা দি টোব্যাকো এটলাসের ২০১৮ সালের সংস্করণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে। এদিকে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ, আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ও ক্যান্সার রিসার্চ-ইউকের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, সরকার সব তামাক থেকে যত রাজস্ব পায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়।
তামাকের পেছনে অর্থব্যয় পরিবেশ, খাদ্য, শিক্ষা ও গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব ফেলে। ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের হাংরি ফর টোব্যাকো শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র অভিভাবকরা যদি তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থের ৬৯ শতাংশ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে, তবে দেশে অপুষ্টিজনিত শিশুমৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।
জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি।
তামাকে ব্যয়িত অর্থ খাদ্য-শিক্ষায় প্রভাব ফেলে
তামাকের পেছনে অর্থব্যয় পরিবেশ, খাদ্য, শিক্ষা ও গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব ফেলে। ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের হাংরি ফর টোব্যাকো শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র অভিভাবকরা যদি তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থের ৬৯ শতাংশ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে, তবে দেশে অপুষ্টিজনিত শিশুমৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস্) ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী তিন কোটি ৭৮ লাখ মানুষ অর্থাৎ ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ তামাক (বিড়ি-সিগারেট, জর্দা, গুল ইত্যাদি) ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, দরিদ্র ও নিরক্ষরদের মধ্যে তামাক সেবনের হার বেশি।
গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছরের শিশুদের মধ্যে ধূমপায়ী ২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের মাস্টার প্ল্যান থাকা জরুরি
সচেতন মহল বিভিন্ন গণমাধ্যম কে বলেন, সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ চায় কি না, সেটা আগে দেখতে হবে। আমরা দেখছি যে দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে তামাক পণ্য বিক্রি হচ্ছে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তামাক পাতা চাষ হচ্ছে আর এই চাষে চাষিদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে জাপান টোব্যাকো সহ কয়েকটি কোম্পানি । সরকার তো এগুলো বন্ধ করছে না। বরং সরকার সুযোগ দিচ্ছে। সরকার কেন চাইবে, এখান থেকে সরকারের বড় অঙ্কের ট্যাক্স আসে। এমনকি তামাক নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করেন, তারাও পুরোপুরি তামাক নিরসন চান না। কারণ, তামাক বন্ধ হলে তো তাদের প্রজেক্টও বন্ধ হয়ে যাবে। সহজ কথায় বলতে গেলে, তারা গুড় সরাতে চান না, কিন্তু মাছি তাড়াতে চান।
‘তামাক নিয়ন্ত্রণে ব্লুমবার্গ বড় অঙ্কের একটা ফান্ড দিচ্ছে, এটা নিয়ে তাদেরও কার্যক্রম আছে। তারাও তামাক নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ফান্ড তৈরি করে। এখন যদি সরকার তামাক একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাহলে প্রথমত উচিত হবে তামাকের কারণে সর্বমোট ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা। কিন্তু সরকার যদি শুধু ট্যাক্সের কথা চিন্তা করে, তাহলে নিয়ন্ত্রণ হবে না।’
আমরা জানি তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারেরও একটা কমিটমেন্ট আছে। কিন্তু সেই ঘোষণা নিয়ে বসে থাকলে হবে না, একটা মাস্টার প্ল্যান থাকতে হবে। একটা নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজিক নিয়ে এগোতে হবে।।
নতুন প্রজন্ম যেন কোনোভাবেই এ পথে পা না বাড়ায়
করণীয় প্রসঙ্গে সচেতন মহল বলেন, ‘তামাক যদি আমরা বন্ধ করতেই চাই প্রথমে তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে সবচেয়ে সহজ প্রক্রিয়া হলো এইটা । এক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ে সরকারকে প্ল্যান সাজাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ দেশের প্রতিটি স্থানে তামাকবিরোধী কার্যক্রম আরও সক্রিয় করতে হবে। তবে যারা ইতোমধ্যে ঢুকে গেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। যারা এখন তামাক নিচ্ছেন তাদের অনেকেই স্বাভাবিকভাবে ২০৪১ সাল পর্যন্ত বাঁচবেন না। তাই সবার আগে নতুন প্রজন্মের তামাকে ঢোকার পথ বন্ধ করতে হবে।’
দ্বিতীয়ত, তামাক উৎপাদন রোধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। যারা তামাক উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। শুধু ট্যাক্স বাড়িয়ে তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়ালে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। যারা তামাকে আসক্ত, তাদের তো থামানো কঠিন। দাম বাড়ালে তারা বিকল্প উপায় বের করবে, অন্যান্য চাহিদা কমাবে। এক্ষেত্রে সরকারকে ধাপে ধাপে এগোতে হবে। সর্বপ্রথম সবচেয়ে ক্ষতিকর যে তামাক, সেটা বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে প্রচারণায় গুরুত্ব দিতে হবে।’
হাফেজি ও কওমি মাদ্রাসাগুলোতে ক্ষতিকর পাতা-জর্দার ব্যবহার বেশি। সেখানে শিক্ষক (হুজুর) ও ছাত্ররা একসঙ্গে তামাক সেবন করেন। তাই মাদ্রাসাগুলোতেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে। বিষয় হচ্ছে, একটা কুঅভ্যাস শুরু করলে পরবর্তীতে সেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন। এক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে পুরোপুরি কীভাবে তামাক থেকে বিরত রাখা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে— বলেন সচেতন মহল।