

শুভ্র মজুমদার, কালিহাতী টাঙ্গাইল
দেশি-বিদেশি সিগারেট ও বিড়ি কোম্পানিগুলো অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রান্তিক কৃষকদের তামাক চাষে আকৃষ্ট করছে। আগাম অর্থ সহায়তা ও উৎপাদন সামগ্রী সরবরাহের মাধ্যমে তারা কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। ফলে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে তামাক চাষ বাড়ছে। এতে একদিকে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, অন্যদিকে উর্বর কৃষিজমির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে পড়ছে।
সরকারি বিধি অনুযায়ী তামাক চাষের জন্য অনুমোদন নেওয়ার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। অধিক লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছর নতুন নতুন জমি তামাক চাষের আওতায় আসছে। বহুজাতিক কোম্পানির অর্থায়ন ও দাদনের প্রলোভনে পড়ে কৃষকেরা দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। বিশেষত, তামাক চাষে ব্যবহৃত ‘কারগিল’ নামক সার চাষি ও তাদের পরিবারের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে, পাশাপাশি জমির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে।
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তামাক চাষ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আশেক পারভেজ।
টাঙ্গাইলের কালিহাতী, ভূঞাপুর, সদর, দেলদুয়ার ও নাগরপুর উপজেলায় তামাক চাষের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বিশেষত কালিহাতীর সল্লা, দেউপুর, চর হামজানী, কদিম হামজানী, পটল, জোকারচর, গোহালিয়াবাড়ী, ভূঞাপুরের গোবিন্দাসী, জগৎপুরা, চর নিকলা, সদর উপজেলার কাকুয়া, হুগড়া, দেলদুয়ারের এলাসিন, নাগরপুরের পাকুটিয়া, ভাদ্রা, মোকনা প্রভৃতি এলাকায় দিগন্তজুড়ে তামাক চাষ হচ্ছে।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, জাপান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানি ও অন্যান্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। সরকারি কোনো তদারকি না থাকায় টোব্যাকো কোম্পানিগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে কৃষকদের এই চাষে উৎসাহিত করছে।
কালিহাতী উপজেলার চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ কৃষক তামাক চাষ করছেন। কৃষক আমির আলী, হারেছ মিয়া, শুকুর মামুদসহ অনেকে জানান, কোম্পানিগুলো বীজ, সার, কীটনাশক, ত্রিপলসহ যাবতীয় সামগ্রী সরবরাহ করে এবং পরে তাদের কাছ থেকেই তামাক পাতা কিনে নেয়।
দীর্ঘ আট বছর ধরে তামাক চাষ করা কৃষক জব্বার মিয়া বলেন, “তামাক চাষে অন্য ফসলের তুলনায় দ্বিগুণ লাভ হয়। শরীরের ও পরিবেশের ক্ষতি হলেও লাভ বেশি হওয়ায় চাষ ছাড়তে পারছি না।”
তিনি জানান, পাতার আকার ও সংরক্ষণের ধরন অনুযায়ী কোম্পানির প্রতিনিধিরা দাম নির্ধারণ করেন, এবং তাদের ছাড়া বাইরের কেউ তামাক কিনতে পারে না।
টাঙ্গাইলের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী সোমনাথ লাহিড়ী জানান, তামাক চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ চাষিদের শরীরে নিউরো-টক্সিক প্রভাব ফেলে এবং এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়। এছাড়া জমির উর্বরতা হ্রাস পায় এবং পরিবেশে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী তামাক চাষের জন্য অনুমতি নেওয়ার নিয়ম থাকলেও টাঙ্গাইলে তা মানা হয় না বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, “বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দাদন দিয়ে কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহিত করে। অসহায় কৃষকেরা না বুঝে তাদের জমি ও জীবনকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং তামাকজাত পণ্যের ওপর কঠোর কর আরোপ করা প্রয়োজন।”
ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন তামাক চাষের সঙ্গে যুক্ত থাকলে ক্যানসার, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, চর্মরোগ, পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া চাষিদের সন্তানরা ‘গ্রিন টোবাকো সিনড্রোম’ নামক একটি জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, “তামাক চাষ ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইন প্রয়োগ করা জরুরি।”
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আশেক পারভেজ বলেন, “তামাক চাষ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো সরকারি নির্দেশনা নেই। তাই এ বিষয়ে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে তামাক চাষ রোধে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
পরিবেশের ক্ষতি, কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হওয়া এবং চাষিদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার কি কার্যকর পদক্ষেপ নেবে? নাকি লোভের ফাঁদে পড়ে কৃষকরা ধ্বংসের পথেই এগিয়ে যাবেন?