

বিজয় কর রতন, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
আধ্যাত্মিক সাধক শাহ শামসুদ্দিন বুখারি (রহ.) এর উরস উপলক্ষে প্রতি বছরের মাঘ মাসের শেষ সোমবার মেলা শুরু হয়ে সপ্তাহব্যাপী চলে এ মেলা। ধর্মীয় উৎসব হলেও এতে অংশ নেন সর্বস্তরের মানুষজন। মেলার অন্যতম আকর্ষণ হলো মাছের হাট। মাছ দিয়ে বরণ করা হয় নতুন জামাইদের। এই মেলায় পাওয়া যায় বিশাল বিশাল মাছ, কাঠের আসবাবপত্র। পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিসহ বিশাল চত্ব রে বসেছে এই মেলা। বাউল সাধকদের আধ্যাত্মিক গান ও সুরের মূর্ছনায় মেলা প্রাঙ্গণে তৈরি হয় এক ভিন্ন আবহ। মেলাকে ঘিরে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয় পুরো এলাকায়।মেলাটি জেলার সবচেয়ে বড় গ্রামীণ মেলা হিসেবে পরিচিত। ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ জেলাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষদের সমাগম হয় এ মেলায়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই মেলা। মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশের ৫০ গ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাই ও স্বজনদের দাওয়াত করা হয়। মেলাকে ঘিরে
কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।
তবে কয়েক বছর ধরে মেলার জিনিসপত্রের দাম চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে বলে ক্রেতাদের অভিযোগ। অবস্থা এমন চলমান থাকলে মেলার আকর্ষণ এবং জৌলুশ হারাবে বলেই মনে করেন আগতরা।যদি ও মেলা কমিটির সংশ্লিষ্টরা বলছেন মূল্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হবে। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, মেলায় জায়গা পেতে তাদের টাকা দিতে হয়, স্থানভেদে ডিমান্ড বেশি হয়। ফলে এর প্রভাব পড়ে জিনিসের উপর। জানা গেছে, প্রায় ৪০০ বছর আগে কটিয়াদী উপজেলার মুমুরদিয়া ইউনিয়নের কুড়িখাই এলাকায় আস্তানা গাড়েন ১২ আউলিয়ার অন্যতম আধ্যা ত্মিক সাধক হজরত শাহ সামছুদ্দীন আউলিয়া সুলতানুল বুখারি (রহ.)। তার মৃত্যুর পর সেখানে গড়ে ওঠে মাজার। প্রতি বছর হযরত শাহ সামছুদ্দীন আউলিয়া সুলতানুল বুখারি (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে বাৎসরিক উরস উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মুরিদ ও সাধকরা এখানে জড়ো হন। সেই থেকে মাজার সংলগ্ন খোলা ময়দানে প্রতি বছর বসে কুড়িখাই মেলা। ওরস ঘিরে এমন মেলা ও উৎসব খুব বেশি দেখা যায় না। মেলার মাছের হাটে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বড় বড় মাছ ওঠে।
এসব মাছ চড়া দামে বিক্রি হয়। শত বছরের পুরোনো এ মেলায় ঢল নামে লাখো মানুষের। মুমুরদিয়া ইউনিয়নের কুড়িখাই মেলায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেলায় প্রচুর মানুষের সমাগম চারদিকে হৈ-হল্লোর শব্দ। রকমারি জিনিসপত্রের শেষ নেই। গ্রামীণ তৈজসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। মেলায় এসেছে নাগরদোলা। শিশুদের জন্য এসেছে বিনোদনের নানান উপকরণ। হৈচৈ শব্দ শিশুদের। নাগরদোলা ঘুরছে আর ছোট থেকে সববয়সী মানুষ আনন্দে মেতেছে। এছাড়াও বিনোদনের আরো নানান উপাদান রয়েছে। কয়েক হাজার কসমেটিক দোকান এসেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেলার অলিগলিতে মানুষের জটলা লেগেই আছে। বিন্নি খৈ, বাতাসা ও জিলাপির দোকান বসেছে কয়েক শতাধিক। এছাড়াও কাঠের অনেক রকম জিনিস ওঠছে। মাছের বাজার সবচেয়ে আকর্ষণীয়। বড় বড় মাছ ওঠেছে
এবার মেলায়। ২৫ কেজি ওজনের কাতল মাছ। বোয়াল মাছ ৩০ কেজি ওজনের উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও প্রায় সবরকম বড় মাছের সমাহার রয়েছে। মাছের বাজারে মানুষের ভিড় লেগে আছে। মুঠো ফোনে ছবি তুলছে অনেকেই বড় মাছের দোকানে। কয়েক শতাধিক মাছের দোকান এবার বসেছে। এ মেলাকে ঘিরে আশপাশের সমস্ত এলাকায় বছরের প্রধান উৎসব হয়ে ওঠে প্রায় শত বছরের প্রাচীন কুড়িখাই মেলা। মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকার পরিবারগুলো আগে থেকেই টাকা জমিয়ে রাখতে থাকে মেলায় খরচ করবে বলে। দূরবর্তী আত্মীয়স্বজনকে মেলার বিশেষ দাওয়াত দেওয়া হয়। চারদিক থেকে এলাকার ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষের সপ্তাহব্যাপী দীর্ঘ লাইন থাকে মেলার দিকে। এই মেলায় সবচেয়ে বড় আকর্ষণ মাছের হাট।
মেলায় বিশাল এলাকাজুড়ে বসে মাছের হাট। এই হাটে বোয়াল, চিতল, আইড়, রুই, কাতল, সিলভার কার্পস, পাঙ্গাস, মাগুর, বাঘাইরসহ নানা ধরণের অন্তত চার শতাধিক মাছের দোকান বসে। স্থানীয় দের বিশ্বাস, মেলার বোয়াল মাছ খেলে এ বছরের জন্য বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তাই বোয়াল মাছের দিকে সাধারণ মানুষের চোখ থাকে বেশি। তবে শুধু বোয়াল নয়, সব ধরনের বড় মাছই মেলায় পাওয়া যায়। মূলত দাওয়াতি জামাইরাই এসব মাছের মূল ক্রেতা। তারা শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে খুশি করতে বড় মাছ কেনেন। মাছ বিক্রেতারা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণো, সুনামগঞ্জের হাওর ও নদী থেকে এক সপ্তাহ পূর্ব থেকে এসব মাছ সংগ্রহ করে মেলায় বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের লোকজন এই মেলা থেকে মাছ কিনে নিয়ে যান। এছাড়া মেলায় হাজারো দর্শক আসেন মাছ দেখতে। মেলার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে প্রতি বাড়িতে মেলা উপলক্ষে নতুন জামাই ও আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াতের রীতি রয়েছে। মাছ বিক্রেতা আলী আহমেদ বলেন, ‘আমি ২৫ কেজি ওজনের কাতল মাছ ১ হাজার ৮০০ শত টাকা কেজি দাম চাচ্ছি, ১ হাজার ২০০ টাকা দাম হাঁকায় ক্রেতা।
ক্রেতা কম আসছে তাই চিন্তার মধ্যে আছি। হয়তো আগামী তিন দিন বিক্রি বাড়বে। মাছ কিনতে আসা এলাকার জামাই ফারুক বলেন, ‘মেলায় মাছের দাম অনেক বেশি। ২৫ হাজার টাকার একটি রুই মাছ কিনছি শ্বশুর বাড়িতে নেওয়ার জন্য।’ মেলায় ঘুরতে আসা সালিম হোসেন বলেন, ‘কুড়িখাই মেলা চিরায়ত বাংলার লোক ঐতিহ্য আর প্রাণের সম্মিলন। এ এলাকার মানুষের কাছে ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দের কুড়িখাই মেলা। মেলা ঘিরে আশপাশের গ্রামে বইছে উৎসবের আমেজ। বংশ পরম্পরায় এলাকার মানুষ ঐতিহ্যবাহী এ মেলা উদযাপন করে আসছে। মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য ও খাদেম শাহ জাফর বলেন, ‘চারশ বছর ধরে চলে আসা কুড়িখাই মেলা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন সর্বজনীন উৎসব ও ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে।
মেলার দোকান বরাদ্দ থেকে যে আয় হয়, তা মাজার ও মসজিদের উন্নয়ন কাজে ব্যয় হয়। মেলা কমিটির সভাপতি কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও মাইদুল ইসলাম ’এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে মেলাটি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। মেলার পরিবেশ ঠিক রাখতে যা যা করণীয় সবকিছু করা হয়েছে। জিনিসপত্রের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বলা হয়েছে। বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে যেন বেশি না হয় তা মনিটরিং করা হয়েছে।