

মালিকুজ্জামান কাকা
বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরিতে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছে যশোরের হালকা প্রকৌশল শিল্প কারখানা গুলো। তাদের তৈরিকৃত যন্ত্রাংশের মান সন্তোষজনক তাই সারা দেশে বাজার সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে কমেছে আমদানি নির্ভরতা। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে রেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সংশ্লিষ্টদের দাবি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি পৃথক শিল্প পার্ক পেলে তারা আরও বহুদূর এগিয়ে যেতে পারবে। যশোর শহরতলীর রাজারহাট রিপন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে তৈরি হচ্ছে রেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। যেগুলো আগে আমদানি করতে হতো। পাশাপাশি এ কারখানায় তৈরি হয় পাথর ও ইট ভাঙা মেশিনসহ গাড়ির যন্ত্রাংশ। কেবল এ প্রতিষ্ঠানেই নয় এমন প্রায় ৫ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত লোহার স্ক্রার্ব গলিয়ে এবং সেই তরল লোহা নতুন ফর্মায় ঢেলে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ।
বিশেষ করে শিল্প কল কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ, ওয়ার্কশপ মেশিনারি, অটোমোবাইল, স্পেয়ার পার্টস, কৃষি যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশ, লৌহঘটিত ও অলৌহঘটিত কাস্টিং পণ্য, ছাঁচ ও ডাই, নির্মাণ যন্ত্রপাতি, সিমেন্ট মিলের খুচরা যন্ত্রাংশ, জাহাজ ও ফিশিং ট্রলারের খুচরা যন্ত্রাংশ, মুদ্রণ ও প্যাকেজিং যন্ত্রপাতি, মেশিন ও সরঞ্জামের প্রায় সকল বিভাগের জন্য খুচরা যন্ত্রাংশ, কারখানার যন্ত্রপাতি, টেক্সটাইল যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের চাহিদা মেটাতে আমদানিই ছিল একমাত্র ভরসা। তবে সেই নির্ভরতা অনেকটা কমে এসেছে। এখন যশোরের বিভিন্ন হালকা প্রকৌশল শিল্প কারখানাগুলোয় তৈরি হচ্ছে এ ধরনের প্রায় দুই শতাধিক যন্ত্রাংশ। যা গুনতগত মানে উন্নত। সারা দেশে যশোর অঞ্চলের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এতে ভারত ও চীন থেকে হালকা প্রকৌশল পণ্য আমদানি কমেছে।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সিনিয়র সহ সভাপতি সিরাজ খান মিন্টু এবিষয়ে বলেন, বর্তমানে যশোরে ছোটবড় মিলিয়ে সহস্রাধিক ওয়ার্কশপে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করেন। ওয়ার্কশপগুলোতে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি আমদানিকৃত পণ্য মেরামতও করা হয়। উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর মধ্যে পাথর ও খোয়াভাঙা মেশিন, ধান ও ভুট্টা ভাঙানো মেশিন, মুড়ি মেশিন, কৃষি পাম্প, টিউবয়েল, পাওয়ার টিলার, বিছালি কাটা মেশিন, চিনি ও তুষ পাউডার মেশিন, কেক মিক্সচার, জাহাজের পাখা, মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলের চাকার রিমের মতো অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী রয়েছে। শতাধিক রকমের গাড়ির পার্টসও উৎপাদিত হয় এখানে। যার মধ্যে গাড়ির ব্রেক ড্রাম, পেসারপ্লেট, গিয়ারবক্স, ব্রেকডিস্ক, ইঞ্জিন হাউজিং, হ্যাঙ্গার, স্প্রিংপাতি, গিয়ার বক্সের বডি অন্যতম।
এছাড়া জুট, রাইস, টেক্সটাইল ও সিমেন্ট মিলের পার্টসও এখানকার কারখানায় উৎপাদিত হয়। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা দামে এসব পার্টস বিক্রি হয় বলেও জানান সিরাজ খান। তিনি আরও বলেন, আমদানি করা হারভেস্টার মেশিনের যন্ত্রাংশও তৈরি করছি। হারভেস্টার একটা পার্টস কিনতে যেখানে ১৫ হাজার টাকা লাগে, আমরা সেটা মাত্র ৪-৫ হাজার টাকায় তৈরি করে দিচ্ছি।
ইঞ্জিনিয়ার আকবার আলী বাবু বলেন, আমরা যেসব মেশিনারিজ তৈরি করি তার অধিকাংশই আগে ভারত থেকে আমদানি হতো। ভারত ও চীন থেকে আমদানিকৃত লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের দাম বেশি। ক্রেতারা বেশি দামের পণ্য নিতে চান না। তারা যশোরে উৎপাদিত পণ্য কিনতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। হামিদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক আব্দুল হামিদ বলেন, প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতি আমরা উৎপাদনে সক্ষম। ইতিমধ্যে আমদানি নির্ভরতা ৫০ শতাংশ কমেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব। এজন্য যশোরে সকল ওয়ার্কশপগুলো এক ছাতার নিচে আনতে পৃথক শিল্প পার্ক গড়ে তুলতে হবে।
এস এম অ্যাগ্রো ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক মোহন আলী বলেন, আমি মূলত কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করি। বছরে আমরা ১০ কোটি টাকার উপরে যন্ত্রাংশ বিক্রি করে থাকি। সরকার যদি আমাদের স্বল্প সুদে ঋণ ও ভর্তুকি মূল্যে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ দিত তাহলে আমরা এ খাতকে আরও উন্নত করতে পারতাম। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আশরাফুল ইসলাম বাবু বলেন, আমাদের নানা সমস্যা রয়েছে। এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ দরকার। পাশাপাশি শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যা সরকারি পৃষ্টপোষকতা ছাড়া সম্ভব না। আমরা চাই সরকার ভর্তুকি দিয়ে আমাদের শিল্পের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করুক। এটা যদি হয় তাহলে আমরা আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রফতানিমুখী হতে পারব।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. মিজানুর রহমান খান বলেন, যশোরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হলে উন্নতমানের মেশিনারিজ আমদানিতে সহযোগিতা দিতে হবে। এর পাশাপাশি দ্রুত বি-ট্যাকের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে ও পৃথক শিল্প পার্ক গড়ে তুলতে হবে। আমরা ইতিমধ্যে কিছু প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছি। এই শিল্পের উন্নয়নে ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে আমরা সকল উদ্যোগ নিতে বদ্ধপরিকর। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির দেয়া তথ্য মতে, যশোরের কারখানা গুলোতে বছরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়। সঠিক পরিকল্পনা করা গেলে তা অচিরেই হাজার কোটি টাকা অর্জন করবে।