মার্চ ২১, ২০২৫
Home » আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
কবমসমত

মানবাধিকার প্রতিদিন,ডেস্ক

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। চতুর্দিকে বেজে ওঠা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের সুমধুর সুর এ দিনের জানান দিচ্ছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন এ দেশের ছাত্র-তরুণরা। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, অহিউল্লাহদের এই আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য উদাহরণ। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

শুধু তাই নয়, ভাষার জন্য একটি জাতির অসাধারণ এই ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থাও (ইউনেস্কো)। ১৯৯৯ সালে এই সংস্থাটি একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এর পর থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হচ্ছে।

এই ভূখণ্ডে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে। এর মূল নায়ক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে পরিষদীয় ভাষা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, ‘পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখের মধ্যে বাংলা ভাষার মানুষ ৪ কোটি ৪০ লাখ। এদিক থেকে বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া দরকার। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পরিষদের নেতা লিয়াকত আলী খান বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের ভাষা মুসলিম রাষ্ট্রের ভাষা হবে।

এর তিন দিন আগে ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ করেছিল তমদ্দুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি ও পূর্ব পাকিস্তান মোছলেম ছাত্রলীগ। পাকিস্তানের মুদ্রা, টিকিট, মানি অর্ডার ফরম, নৌ ও অন্যান্য বিভাগে নিয়োগের জন্য টেস্ট পরীক্ষায় বাংলা ভাষা বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে দাঁড়িয়েছিলেন তারা। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর প্রতিবাদে মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগীয় শহরের কলেজ, স্কুলগুলোতে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ-প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। পুলিশের লাঠিচার্জে পূর্ব বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকসহ প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছিলেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৫২ সালে। ভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। সেদিন ভোরবেলায় ছা্ত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়েছিলেন। সভা-মিছিল বন্ধ করার জন্য সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন। আমতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সকাল ১১টার দিকে সাধারণ ছাত্রসভা শুরু হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ১০ জন করে শিক্ষার্থীর এক একটি দল মিছিল নিয়ে বের হবেন।

এদিকে পুলিশ লাঠি হাতে কর্ডন করে ফটকে দাঁড়িয়ে আর বাকিরা রাইফেল হাতে পজিশন নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। পুলিশি তৎপরতার মুখে গ্রেপ্তার এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা প্রতিটি দলের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। হালিমা খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, সাফিয়া খাতুন স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় দলের ছাত্রদের পুলিশ ট্রাকে তুলে নেয়। আপসহীন বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের ধাক্কায় পুলিশ কর্ডন ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ।

তৎকালীন পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, বিকেল প্রায় ৩টার দিকে মিছিল মেডিকেল কলেজের মোড়ে পৌঁছলে জেলা প্রশাসক কোরেশীর নির্দেশে পুলিশ অবিরাম গুলিবর্ষণ করেছিল। পুলিশের গুলিতে সেদিন শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্র মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন, আব্দুল জব্বার, আবুল বরকত এবং বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিকউদ্দীন আহমদ (২৭) মারা যান। তবে পরবর্তীকালে সালাহউদ্দীন সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিতে ছাত্রদের মৃত্যুসংবাদে বাংলা ভাষার প্রাণের দাবি সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চালানো হলে নিহত হন আবদুস সালাম, সফিউর রহমান ও কিশোল অহিউল্লাহ। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৫২ সালের অবিস্মরণীয় সেই ঘটনার পর প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেওয়ার পর একই সঙ্গে পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

Loading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *