মার্চ ১৫, ২০২৫
Home » সেনাবাহিনীই ভাষা আন্দোলনের অগ্রপথিক
IMG-20250220-WA0007(1) (1)

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি ( অব)

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আমাদের সেনাবাহিনী দেশের প্রতিটি ক্রান্তি লগ্নে দেশের স্বার্থকে সমুন্নত রাখে। সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠালগ্নেও এর জ্বলন্ত একটি ঘটনা বা উদাহরণ তারা সৃষ্টি করেন। আমরা ভাষা আন্দোলনে তমুদ্দুন মজলিস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবদান সম্পর্কে অবহিত। পরিতাপের বিষয় বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সদস্যগণের ত্যাগের ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা নেই। আর তা হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠা দিবসে তা সংঘঠিত হয়েছিল। শুনে অনেকেই অবাক হবেন যে, এ রেজিমেন্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্পষ্টভাষী, তেজস্বী, নির্ভীক ও দুঃসাহসী অফিসার মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি ও মেজর এম আই হোসেন-ই সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তৎকালীন শাসকগোষ্টী বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য করতে থাকেন। তাদের যুক্তি ছিল বাংলা ভাষার উপর ভারতের পশ্চিম বঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যান্য হিন্দু লেখকদের ব্যাপক আধিপত্য বিধায় এদেশের বাঙ্গালি মুসলমানগণ হিন্দুদের ধর্ম ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এক সময়ে পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্যতার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। কেননা, পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দুত্ববাদের প্রভাব ছিল খুবই শক্তিশালী; যা সম্ভব হয়েছিল বাংলাভাষায় তাদের আধিপত্বের কারণে।
এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাথা মোটা পশ্চিমা শাসকগোষ্টি মাতৃভাষা, প্রাণের বাংলা ভাষাকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং তা প্রকাশ ও পরিস্কার হয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন ইস্টার্ণ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খানের (পরবর্তীতে ফিল্ড মার্শাল ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট) একটি উক্তি বা নির্দেশের মাধ্যমে। যা অগ্নিস্ফূলিঙ্গের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীতে। যা আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা ‘দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ এর প্রতিষ্ঠা: পরিতাপের বিষয় ছিল ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যান্য জাতি-গোষ্টির নামে নিজস্ব বাহিনী থাকলেও বৃহত্তর জনগোষ্টি বাঙ্গালীদের জন্য কোন সেনাবাহিনীর রেজিমেন্ট ছিল না বা করা হয়নি। ফলে বাঙ্গালী জনগোষ্টি অবহেলিতই থেকে যায়। এ থেকে উত্তরণের জন্য ব্রিটিশ শাসনামলে দুঃসাহসী দেশপ্রেমিক কয়েকজন বাংগালী মুসলমান সেনা অফিসার বাংগালী রেচিমেন্ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের পর অতি অল্প সময়েই বাংলার বাঙালী মুসলমানদের বহুল প্রতিক্ষিত প্রাণের আকুতি, জেনারেল ওসমানি, জেনারেল ইশফাকুল মজিদ, মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি, মেজর এম আই হোসেন প্রমূখের আজীবন লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করতে শুরু করে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ সকল বাঙ্গালি মুসলমান অফিসার ও আরো অনেকের ইচ্ছানুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব সুসংহত ও রক্ষা করার অভিপ্রায়ে বাঙালী মুসলমানদের জন্য একটি রেজিমেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যার নামকরণ করা হয় ‘দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। উল্লেখ্য সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের নাম ছিল ‘ইস্ট বেংগল’।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদরদপ্তর হতে এ রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ম ইস্ট বেঙ্গল গঠন করার জন্য পত্র জারী করা হয়। ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুল গনি ও ক্যাপ্টেন এস ইউ খানকে দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকা সেনানিবাসে এ ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। মেজর এ. ডব্লিউ. চৌধূরী ও মেজর সাজাউয়াল খানকে এ ইউনিটের দু’টি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ক্যাপ্টেন গণি ও অন্যান্য অফিসারগণের আপ্রাণ চেষ্টায় মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গঠনের সকল প্রস্তুতি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সেনা অফিসার লেঃ কর্ণেল ভি. জে. ই. প্যাটারসনকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে নিয্ক্তু করা হয়। সকল জ্বল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় বাঙালী মুসলমানদের বহু প্রতিক্ষিত সে মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয় । এ ঐতিহাসিক দিনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ম ইস্ট বেঙ্গল, যা ‘সিনিয়র টাইগার’ নামে পরিচিত।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের ইতিহাসে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন, প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন, মন্ত্রী নবাব হাবিবউল্যাহ, মন্ত্রী হাসান আল, মন্ত্রী নূরুল আমীন, মন্ত্রী আফজাল খান, মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার, মন্ত্রী আবদুল হামিদ খান, সামরিক বাহিনীর উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আইউব খান, উচ্চ পদস্থ সকল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ।
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা উত্তোলন করেন গভর্ণর জেনারেল স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন ।শুরু হয় বাঙালীদের গৌরবময় ইতিহাসের শুভযাত্রা এবং মার্শাল রেস (যোদ্ধা জাতি) হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ। অবমোচন হলো দুইশত বছরের গ্লানি ও অবমূল্যায়ন। এর মাধ্যমে বীজ বপণ করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট শুরুতেই আত্মপ্রকাশ করে একটি উজ্জ্বল সূর্যের ন্যায় । এ যেন আমাদের জাতীয় পতাকারই রক্তিম লাল সূর্যের প্রতিচ্ছবি। ‘সৌম্য, শক্তি ও ক্ষিপ্রতা’র মুলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার দীপ্ত আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে ‘বঙ্গ শার্দুল’বাহিনী। তখন কে জানতো যে, এ রেজিমেন্টই একদিন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করবে!
ভাষা আন্দোলনের সূচনা: এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন যে, আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের চা চক্রে এক অনাকাংখিত অথচ যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান সকলের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখার এক পর্যায়ে বলেন, “From now on-words Bengali Soldiers will speak in Urdu, not in Bengali.” সাথে সাথেই এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করে সেখানে উপস্থিত মেজর এম আই হোসেন বলে উঠেন, “Excuse me Sir, in West Pakistan Pathan soldiers have allowed to speak in Pestoo and Urdu. Similarly our Bengali soldiers should be allowed to speak in Bengali and Urdu.” ক্ষুব্ধ আইয়ুব খাঁন বলেন, “Nonsense, absurd sit down.” ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খানকে লক্ষ্য করে সকলের সামনে আবেগতাড়িত হয়ে বলে উঠলেন, “Excuse me Sir, whatever Major M. I. Hossain has said is not correct. We Bengali soldiers will never speak in Urdu, but in our mother tongue Bengali.” এর জবাবে আইয়ুব খান “Shut up. Sit down.” বলে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) গণিকে থামিয়ে দেন। এ দুঃসাহসীক ভূমিকার জন্য এ সময় হতেই তাঁকে যেমন ‘টাইগার গণি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই আবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ মেজর এম আই হোসেন ও ক্যাপ্টেন গণির এ দুঃসাহসিকতাকে চরম অসদাচরণ মনে করে তাঁদের বিরুদ্ধে লেগে পড়ে। ফলে, তাঁদের পদোন্নতি স্থগিত হয়ে যায় এবং নানা ভাবে তাঁদেরকে লাঞ্চিত করা হয়। দেশ, জাতি ও মাতৃভাষার সম্মান, মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার জন্য এরকম দুঃসাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতার উদাহরণ একেবারেই বিরল এবং ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় তা অকল্পনীয়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, পাকিস্তান স্বাধীন হবার মাত্র ছয়মাস পর এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার অনেক পূর্বেই এ ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালেই প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় সেনাবাহিনীর মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি ও মেজর এম আই হোসেন হলেন মহান ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারী ও মহানায়ক।
তাই বলতে দ্বিধা নেই যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মহান ভাষা আন্দোলন একই সুত্রে গাঁথা। অথচ সেনাবাহিনীর এ অতি গুরুত্বপূর্ণ বীরত্বগাঁথার ইতিহাস আমরা জানি না এবং সেনাবাহিনীকে খাঁটো করার মানসিকতা পোষণ করি। আজ এ কথা স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি  এবং এটাই বাস্তব সত্য যে, ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সে সকল মহান ত্যাগী ব্যক্তিদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে আমরা পেয়েছি একটি পতাকা ও একটি দেশ এবং কথা বলতে পারছি প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষায়। মহান আল্লাহ্ সুবাহানু ওয়া তায়ালার নিকট তাঁদের রুহের মাগফেরাত ও  জান্নাতে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করার জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করছি।

 

Loading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *