মার্চ ২১, ২০২৫
Home » স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই ভূমি সংস্কারে উদ্যোগ নেয়নি
bnbfh

মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে ভূমি সংস্কারের ইতিহাস রয়েছে। মেক্সিকো, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলোর ভূমি সংস্কার তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভূমি সংস্কার

মেক্সিকোর বিপ্লবের (১৯১০-১৯২০) পর দেশটিতে ব্যাপক ভূমি সংস্কার করা হয়, যেখানে কৃষকদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর জমি উদ্ধার করে কৃষকদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়। চীনে ১৯৪৯-৫০ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর কৃষকদের হাতে জমির মালিকানা তুলে দেওয়া হয়, যা দেশটির কৃষি ও অর্থনীতিতে বিপ্লব আনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দক্ষিণ কোরিয়াও ভূমি সংস্কারের মধ্য দিয়ে আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলোপ ঘটায়। একইভাবে জাপান, তাইওয়ানসহ আরও অনেক দেশে ভূমি সংস্কার কার্যকর হয়েছিল।

বাংলাদেশের বাস্তবতা

গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ছয় মাসেও ভূমি সংস্কার নিয়ে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি সরকার। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ১১টি কমিশন গঠন করা হলেও প্রান্তিক কৃষকের ভূমি মালিকানা নিশ্চিত করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আইএফপিআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৬ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের কোনো জমি নেই, অথচ মোট কৃষিজমির ৬৬ শতাংশ দখলে রয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ পরিবারের।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা মনে করছেন, দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা অন্যায্য হয়ে পড়েছে এবং ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিবিদ ড. কেএএস মুরশিদ বলেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হলেও ভূমির বিষয়টি উপেক্ষিত। কৃষকের হাতে জমির অভাব থাকায় ভূমি ব্যবস্থাপনার পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন।’

ভূমিহীন কৃষকের দুর্দশা

দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশের বেশি কৃষিখাতে নিয়োজিত, যার মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ কৃষি কাজ করেন। তবে ভূমিহীন কৃষকরা জমি বর্গা নিয়ে আবাদ করতে বাধ্য হন এবং উৎপাদনের অর্ধেক জমির মালিককে দিতে হয়। ফলে তাদের আয় কমে যায়। আইএফপিআরআইয়ের গবেষণা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগের ৬৭.৮ শতাংশ, সিলেট বিভাগের ৬৪.৯ শতাংশ, ঢাকার ৫৫ শতাংশ, রংপুর ও বরিশালের ৫৪.৬ শতাংশ, রাজশাহীর ৫২.১ শতাংশ এবং খুলনার ৪৭ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের কোনো ভূমি নেই।

ভূমি আইন ও সীমাবদ্ধতা

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপের পর জমির সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা হলেও ১৯৬১ সালে তা ৩৭৫ বিঘা করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পুনরায় ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৪ সালে এই সীমা ৬০ বিঘায় নামিয়ে আনা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে আইন সংশোধন করলেও কার্যকর কোনো পরিবর্তন আসেনি।

ভূমি সংস্কার বোর্ডের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘বর্তমান আইনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও কার্যকর ভূমি সংস্কার হয়নি। ভূমি মন্ত্রণালয়ই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’ ভূমি অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, আইনের মধ্যে কিছু শব্দের পরিবর্তন হলেও বাস্তবে ভূমিহীনদের জন্য কোনো পরিবর্তন আসেনি।

আইনজীবীরা মনে করেন, বর্তমান ভূমি আইন সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোর্শেদ বলেন, ‘একই আইনে কৃষি জমি এবং অনাবাদি জমির জন্য একই সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা যৌক্তিক নয়। এসব বিবেচনা করে নতুনভাবে ভূমি সংস্কার আইন তৈরি করা দরকার।

বাংলাদেশের কৃষির টেকসই উন্নয়নের জন্য ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত। তবে স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকারই কার্যকর ভূমি সংস্কার করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার যদি ভূমিহীন কৃষকদের অধিকার নিশ্চিত করতে উদ্যোগ না নেয়, তাহলে কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়তে পারে।

Loading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *