মার্চ ২৫, ২০২৫
Home » বিএনপি-জামায়াতের দ্বন্দ্ব সংঘাত সংঘর্ষ 
1000081895

মো:আজগর আলী, চট্টগ্রাম

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।এদু’দলের সম্পর্ক সব সময় রহস্যময় কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো গোপনে।দু’দলই কখনো ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র,আবার কখনো নানা কারণে দ্বন্দ্ব,রাগ অভিমান অভিযোগে লিপ্ত। এবার যা প্রকাশ্যে দৃশ্যমান।এই দল দুটির মধ্যে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ৫ই আগষ্টের পরে স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপি মূলত একটি জাতীয় তাবাদী রাজনৈতিক দল,যেখানে জামায়াত ইসলামী একটি ইসলামপন্থী দল। বিভিন্ন সময়ে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ, আদর্শিক পার্থক্য এই জোটের মধ্যে ফাটল ধরিয়েছে। এবার  বিএনপি-জামায়াতের দ্বন্দ্বের কারণ, প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পর্যালোচনা করা যাক,বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়।

দলটি মূলত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল অবলম্বন করে। বিএনপির সমর্থন মূলত মধ্যবিত্ত,ব্যবসায়ী শ্রেণি ও কিছু অংশের গ্রাম্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিস্তৃত।অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী ও তার রাজনৈতিক অবস্থান হলো:বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ১৯৪১ সালে আবুল আলা মওদুদী(রহ) চিন্তাধারার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দলটি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়, যার ফলে পরবর্তী সময়ে এটি বাংলাদেশে বিতর্কিত রাজনৈতিক দল হিসেবে চিহ্নিত হয়। জামায়াত ইসলামী মূলত ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে রাজনীতি করে এবং তাদের প্রধান সমর্থক গোষ্ঠী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের একটি অংশ।

বিএনপি-জামায়াত জোট গঠনের প্রেক্ষাপট ১৯৯০-এর দশকে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপি ও জামায়াত একে অপরের কাছাকাছি আসে। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের অংশ হিসেবে জামায়াত ক্ষমতায় আসে। সেই সময় জামায়াতের দুই নেতা মন্ত্রিত্বও লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিএনপির রাজনৈতিক ব্যার্থতা ও ৫ই আগষ্টের পরে জামায়াতে ইসলামীর কৌশলী রাজনীতির কারনে দু’দলের মিত্রতার মধ্যে ফাটল ধরে।বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী দল,যেখানে জামায়াত ইসলামী একটি ইসলামপন্থী দল। বিএনপির অনেক নেতা কর্মী ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান করলেও তারা ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের পক্ষে নয়। অন্যদিকে, জামায়াত ইসলামী শারিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে রাজনীতি করে। এই আদর্শিক পার্থক্য দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির একটি বড় কারণ।

১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ ইস্যু জামায়াতের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করে আবার আওয়ামীলীগের সাজানো যুদ্ধাপরাধের বিচার জামায়াতে ইসলামীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ও বড় দুঃসময় পার করে,বিএনপি  জামায়াতের দু:সময়ে  যুদ্ধাপরাধের ইস্যুতে অনেকটা নীরব থেকে রাজনৈতিক সুযোগ নিতে চেষ্টা করে যা জামায়াত ভালোভাবে নেয় নি।২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের সাজানো  বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সাজা হলেও বিএনপি কৌশলগত কারণে তেমন কোনো শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারেনি। এতে জামায়াতের অনেক নেতাকর্মী বিএনপির ওপর অসন্তুষ্ট ও হতাশ হয়।

বিএনপির আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অবস্থান ও জামায়াতের বিষয়ে জামায়াতের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে জামায়াতকে অনেক দেশ বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব সন্দেহের চোখে দেখে এ-সব কারণে ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে অভিযোগ রয়েছে এসব চিন্তা করে এবং বিএনপি যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় জামায়াত থেকে সম্পর্ক দূরে রাখে,যা জামায়াতের বর্তমান নেতৃবৃন্দ ভালোভাবে নেয় নি। তখন জামায়াতের সাথে তাদের সম্পর্ক শীতিল হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া বিএনপি অনেক ক্ষেত্রে বাম দল গুলো কে পাশে পাওয়ার আশায় জামায়াত থেকে দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নেয় যা বর্তমান সম্পর্ক অবনতির আরেকটা কারণ।২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি ও জামায়াত একত্রে সরকার চালালেও, ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বিএনপির অনেক নেতাই জামায়াতকে ছোট রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখে এবং তাদের বেশি সুবিধা দিতে রাজি

ছিল না। অন্যদিকে,জামায়াত নিজেদের ভূমিকা বাড়ানোর চেষ্টা করছিল। এই স্বার্থের সংঘাত দুই দলের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি করে।২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি, কিন্তু জামায়াত এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি জামায়াতের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে অংশ নেয়। ফলে বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়ে।বিএনপি-জামায়াতের দূরত্বের ফলে বিএনপির সংগঠনগত দুর্বলতা আরও প্রকট হয়েছে। জামায়াতের কর্মীরা মাঠপর্যায়ে বিএনপির জন্য অনেক কাজে আসত, কিন্তু বর্তমানে সে সহযোগিতা নেই।জামায়াতে ইসলামী এককভাবে রাজনীতি করতে চাইছে, কিন্তু বিএনপির সহযোগিতা ছাড়া তাদের পক্ষে মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসা কঠিন রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও ভবিষ্যৎ জোটের সম্ভাবনা অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বিএনপি ও জামায়াত ভবিষ্যতে কোনো কৌশলগত সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় দুই দলই আলাদা রাজনীতি করছে।

আবার বিএনপি  জামায়াতকে পুরোপুরি ত্যাগ করেনি।জামায়াতও ঘোষণা দিয়ে বিএনপির সাথে কোনো সম্পর্ক চিন্ন করেন নি।বিএনপি বর্তমানে জামায়াতের সাথে দূরত্ব বজায় রাখলেও, তারা পুরোপুরি সম্পর্ক ছিন্ন করবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।জামায়াতও মাঠ পর্যায়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও বরাবরই বিবৃতি দিয়ে বলছে বিএনপির সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের সাথে আমরা আছি।৫ই আগষ্টের পরে জামায়াত দলীয় সংস্কার এবং নতুন মিত্র খোঁজার চেষ্টা করছে, যা ভবিষ্যতে তাদের রাজনীতিতে নতুন দিক খুলে দিতে পারে।বিএনপির এতে হতাশ ও জামায়াতের ওপর ক্ষিপ্ত।আগামী নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতকে জোটে আনবে কি না, তা স্পষ্ট নয়,জামায়াত জোটবদ্ধ নির্বাচন করবে কি না,তাও অস্পষ্ট।বিএনপি-জামায়াতের এরকম অনঢ় সিদ্ধান্ত মুলত কর্মীদের দ্বন্দ্বের অন্যতম কারন।দু’দলের কর্মীরা অনেকটা হতাশা ও অনিশ্চয়তা থেকে যোগাযোগ ও সৌজন্যবোধ থেকেই দূরে সরে যাচ্ছে ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় গুলো নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটছে।সুবিধাভোগী কর্মীদের স্বার্থ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা পদে পদায়ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এসব কারণে সৃষ্টি হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।তবে দেশের এরকম ভঙ্গুর অবস্থায় দু’দলের মুখোমুখি অবস্থা থেকে চরমভাবে হতাশ হচ্ছে সাধারণ মানুষ,তা ছাড়া জামায়াত এই মুহুর্তে জাতীয় নির্বাচন করতে রাজি নয়, বিএনপি খুব শীঘ্রই জাতীয় নির্বাচন চাই যা দু’দলের সম্পর্কের অবনতির আরেকটি কারন।সাধারন জনতার প্রত্যাশা বর্তমানে দু’দলের দূরত্ব কমিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠনের মাধ্যমে জাতীয়  নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া।

Loading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *