

মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার
বর্তমান সমাজে প্রশাসন, রাজনীতি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমনকি পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পরিসরে এক অস্থিরতার আবহ স্পষ্ট। নাগরিক অধিকার, ন্যায়বিচার, মানবিকতা এবং নৈতিকতার প্রশ্নে যেসব অযাচিত আচরণ দেখা যাচ্ছে—তার মূল উৎস হিসেবে উঠে আসছে একটি সাধারণ বাস্তবতা: ক্ষমতার অপব্যবহার। সমাজবিজ্ঞানী, রাজনীতি বিশ্লেষক, প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকারকর্মীরা একমত যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন নিজেদের ক্ষমতা সীমা অতিক্রম করে নিজের সুবিধা, প্রতিপত্তি বা দমনমূলক কৌশলের জন্য ব্যবহার করে, তখনই অযাচিত আচরণ ও অনিয়ম সমাজব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়ে।
ক্ষমতা যখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়
বিশ্লেষকগণ মনে করেন, রাজনৈতিক প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমেও ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতার বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। একজন জনপ্রতিনিধি যখন তার অবস্থানকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা যখন সাধারণ নাগরিককে ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা যখন দুর্নীতির মাধ্যমে ফাইল অগ্রগতি নিশ্চিত করেন—সবক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপব্যবহার কার্যত অনিয়মের জন্ম দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবির বলেন,
“অযাচিত আচরণ, নিপীড়ন, দুর্নীতি ও অনাচারের সবচেয়ে বড় উৎসই হলো ক্ষমতা ব্যবহারের অনিয়ন্ত্রিত এবং দায়হীন রূপ। যখন কোনো পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন সেই দায়িত্বের সঙ্গে জবাবদিহিতাও থাকা উচিত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে কম বিচার হয়।”
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার ঘাটতি
বর্তমান সময়ের বহু আলোচিত ঘটনাগুলো—যেমন: পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিচারহীনতা, সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির মামলা আটকে যাওয়া ইত্যাদি—প্রমাণ করে যে ক্ষমতার অপব্যবহার কেবল ব্যক্তিগত অনৈতিকতার বিষয় নয়, এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। সুশাসনের জন্য প্রয়োজন জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও শক্তিশালী তদন্ত প্রক্রিয়া—যার ঘাটতিই আজ ন্যায়বিচারের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অযাচিত আচরণের বহুমাত্রিক রূপ
ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু অর্থনৈতিক দুর্নীতি বা দমন-পীড়নে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি সামাজিক, পারিবারিক ও কর্মস্থলের পরিবেশেও তার প্রভাব ফেলে। একজন কর্পোরেট ম্যানেজার যখন অধস্তন কর্মচারীদের সম্মান না দিয়ে কাজ করান, একজন শিক্ষক যখন ছাত্রদের মানসিকভাবে নির্যাতন করেন, বা একজন বাবা-মা সন্তানদের মতামত উপেক্ষা করে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন—সেখানেও একধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার বিদ্যমান।
জনগণের নীরবতা ও ভয়ভীতি
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জনগণের মধ্যে ভয়, নৈরাশ্য ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি তৈরি হওয়াও ক্ষমতার অপব্যবহারকে টিকিয়ে রাখে। অনেকেই অভিযোগ করলেও বিচার না পাওয়ার অভিজ্ঞতায় আর কেউ প্রতিবাদ করেন না। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন জনমত গঠন, শক্তিশালী গণমাধ্যম, এবং বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা।
মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও অধিকার’–এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম বলেন,
“ক্ষমতাবানদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত না করলে সমাজে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না। জনগণ যদি তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন না হয়, তবে তারা প্রতিনিয়ত ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়েই যাবে।”
সমাধানের পথ
সমাজে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে নিচের কিছু বিষয় বাস্তবায়ন জরুরি—
- শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা: রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থাই পারে ক্ষমতাবানদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে।
- সুশাসনের সংস্কৃতি গঠন: প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
- গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: ভয়ভীতি ও দমননীতি ছাড়াই সত্য প্রকাশের অধিকার থাকতে হবে সাংবাদিকদের।
- নাগরিক সচেতনতা ও গণপ্রতিরোধ: যে কোনো অনিয়ম বা ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও প্রতিবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
“ক্ষমতার অপব্যবহারই অধিকাংশ অযাচিত আচরণের মূল উৎস”—এই বাক্যটি কেবল একটি মন্তব্য নয়, বরং এটি একটি বাস্তবতা, সমাজতাত্ত্বিক সতর্কতা এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবিক সমাজ গঠন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে সর্বস্তরের ক্ষমতাবানদের দায়বদ্ধ করতে হবে। নইলে অযাচিত আচরণ একসময় সমাজের মানসিক কাঠামোকে ভেঙে দেব