জুন ২০, ২০২৫
Home » সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনে নতুন অধ্যাদেশ জারি
1747023414-f3ccdd27d2000e3f9255a7e3e2c48800

মোঃ শাহজাহান বাশার ,স্টাফ রিপোর্টার

আওয়ামী লীগসহ কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার জন্য আইনগত কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ সংশোধন করে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। রবিবার (১১ মে) রাতে এই সংশোধিত অধ্যাদেশটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।

জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় সংবিধানের ৯৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। সংশোধিত অধ্যাদেশটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে সরকার এখন যেকোনো ব্যক্তি বা সত্ত্বার বিরুদ্ধে, যাকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত মনে করা হচ্ছে, কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা, সভা-সমাবেশ এবং সংবাদ সম্মেলন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার আইনগত ক্ষমতা অর্জন করেছে।

প্রধান সংশোধনসমূহ যা এই অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে:
১. ধারা ১৮ সংশোধন:
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ধারা ১৮(১) এ যেখানে বলা ছিল, “সত্ত্বাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে”, তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে – “বা সত্ত্বার যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে”। অর্থাৎ সরকার এখন কেবল নিষিদ্ধ ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কার্যক্রম নিষিদ্ধ করারও নির্দিষ্ট বিধান পেল।

২. ধারা ২০ সংশোধন:
ধারা ২০-এর বেশ কয়েকটি উপধারা ও দফায় গুরুত্বপূর্ণ শব্দ পরিবর্তন ও প্রসারণ করা হয়েছে।

  • উপধারা ১-এ ‘তালিকাভুক্ত’ বা ‘নিষিদ্ধ’ শব্দের পরিবর্তে ‘ধারা ১৮-এর অধীন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তি বা সত্তা’ উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে বিচারাধীন, তদন্তাধীন বা প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও আইন প্রয়োগ করা যাবে।
  • উপধারা (১)(গ)-এর ‘নিষিদ্ধ’ শব্দের জায়গায় ‘উক্ত’ শব্দ প্রতিস্থাপন করে যেকোনো সত্তার পক্ষে প্রচারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরিধি বাড়ানো হয়েছে।
  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল দফা (ঙ) পুনর্লিখন, যেখানে বলা হয়েছে:

    “উক্ত সত্ত্বা কর্তৃক বা সেটির পক্ষে বা সমর্থনে যে কোনো প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা বা মুদ্রণ কিংবা গণমাধ্যম, অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, অথবা মিছিল, সভা-সমাবেশ বা সংবাদ সম্মেলন আয়োজন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা দেওয়া নিষিদ্ধ করা হবে।”
    এই বিধান কার্যত রাজনৈতিক প্রচারণা, মিডিয়া অংশগ্রহণ এবং জনসমাবেশকে সম্পূর্ণরূপে সীমিত করে দিয়েছে।

৩. ধারা ২০-এর অন্যান্য উপধারায়ও ‘নিষিদ্ধ’ শব্দের পরিবর্তে আরও বিস্তৃত পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যাতে এই বিধান প্রয়োগে আইনি বাধা কমে এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপে স্বচ্ছতা তৈরি হয়।

নতুন অধ্যাদেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন আলোড়ন দেখা দিয়েছে, তেমনি আইন বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন। অনেকেই মনে করছেন, এই সংশোধন বাস্তবিক অর্থেই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দল বা জোটের বিরুদ্ধে আইনি ভিত্তিতে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথ খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে এই অধ্যাদেশ জারির সময় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

সরকারি সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, সংশোধিত অধ্যাদেশের মাধ্যমে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক মহলে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা নেই। বরং, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করায় আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো তা সমর্থন করবে বলেই সরকার আশা করছে।

প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত বা দেশবিরোধী তৎপরতা চালানো কোনো দল বা সত্ত্বার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই সহানুভূতিশীল নয়। বরং জার্মানি, স্পেন, বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ অতীতে নেওয়া হয়েছে।”

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এই সংশোধিত অধ্যাদেশ বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, আইনগত কাঠামোর মাধ্যমে একটি সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের পুরো কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা এখন সরকারের হাতে এসেছে। এটি কেবল সাময়িক নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং সংগঠনের নাম ব্যবহার করে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের প্রচার, সভা, বা নির্বাচনী কার্যক্রমের সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এই অধ্যাদেশ জারি ও কার্যকরের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দিনের রাজনীতি, নির্বাচন ও জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে দেশবাসীর দৃষ্টি এখন নিবদ্ধ থাকবে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে।

Loading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *