জুলাই ১২, ২০২৫
Home » সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ ও লাইভ সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা: টাঙ্গাইল জেলা খাদ্য কর্মকর্তার লিখিত নির্দেশ ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক

মোঃ শাহজাহান বাশার , স্টাফ রিপোর্টার,

ভূঞাপুর খাদ্য গুদামে সাংবাদিকদের ভিডিও ও তথ্য সংগ্রহে বাধা, হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় মহাপরিচালকের নির্দেশনার কথা উল্লেখ, বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের প্রশ্ন—গোপন দুর্নীতিই কি আসল কারণ?

টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলায় অবস্থিত খাদ্য গুদামে তথ্য সংগ্রহ ও লাইভ সম্প্রচারে সাংবাদিকদের বাধা প্রদান ও বিতর্কিত নির্দেশনা জারির অভিযোগ উঠেছে জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম ভুঞার বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং তথ্য অধিকার আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি সরাসরি লিখিতভাবে সাংবাদিকদের কার্যক্রমে বাধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

গত ১৫ই জুন (রবিবার) ডিবিসি নিউজের একটি প্রতিনিধি দল ভূঞাপুর উপজেলার খাদ্য গুদামে সরকারি খাদ্য সংগ্রহ কার্যক্রমের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই করতে গেলে গুদাম কর্মকর্তারা তাদের তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং একটি লিখিত বার্তা দেখিয়ে জানান—কোনো ভিডিও ধারণ, সাক্ষাৎকার গ্রহণ কিংবা লাইভ সম্প্রচার করা যাবে না।

জেলা খাদ্য কর্মকর্তার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেওয়া বার্তায় লেখা হয়—“এইমাত্র ডিজি মহোদয়ের সাথে কথা বললাম। কোনো সাংবাদিকের গুদামের টেরিটোরির মধ্যে ঢুকে লাইভ করার কোনো সুযোগ নাই। গুদামের অভ্যন্তরে ঢুকে কোনো সাক্ষাৎকার এবং কোনো লাইভ করতে দিবেন না। এতে মহাপরিচালক মহোদয়ের সদয় সম্মতি রয়েছে। যদি সাক্ষাৎকার এবং লাইভ করতে হয় তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। যেহেতু আমাদের গুদাম কেপিআই এরিয়ায়। আপনারা মনে রাখবেন আমরা সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি। মন্ত্রণালয়ের এই সংগ্রহ কার্যক্রমকে সবাই মিলে আমরা সফল করব। এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।”

এই বার্তা দেখিয়ে ভূঞাপুর গুদাম কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বের করে দিতে চান। এমনকি তাদের ক্যামেরা চালু রাখার বিষয়েও আপত্তি তোলা হয়। বলা হয়, “তথ্য অধিকার আইনের আশ্রয় ছাড়া কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না।”

এ ঘটনা নতুন নয়। পূর্বেও টাঙ্গাইল জেলা খাদ্য বিভাগের বিরুদ্ধে গম-চাল সংগ্রহে জালিয়াতি, ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগে একাধিক জাতীয় গণমাধ্যম রিপোর্ট প্রচার করে। এর জেরে দুদক অভিযান চালিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতাও পায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাংবাদিকদের প্রবেশ ও তথ্য সংগ্রহে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্য, ভবিষ্যতের দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়া।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি খান মোহাম্মদ খালেদ বলেন—“কেপিআই এলাকায় সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবে না—এটি সবাই জানে। কিন্তু যেভাবে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দিয়ে সাংবাদিকদের অপমান করা হয়েছে, তা তাদের দায়িত্বশীলতাকে অপমানিত করেছে। এটি একটি দুর্নীতিপরায়ণ অপপ্রয়াস।”

এই বিষয়ে মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম ভুঞার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি প্রথমে বলেন—“কেপিআই এলাকায় প্রবেশ নিষেধ।”কিন্তু সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ও তথ্য অধিকার প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি হঠাৎ ফোন কেটে দেন।বাংলাদেশের তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, সরকারি কার্যক্রম, ব্যয়ের হিসাব এবং জনস্বার্থে প্রাসঙ্গিক তথ্য জানার অধিকার রয়েছে প্রতিটি নাগরিকের, সাংবাদিকদের তো বটেই। কেপিআই এলাকার নিরাপত্তাজনিত নিয়ম থাকলেও সেখানে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে বাধা দেওয়া আইনবিরুদ্ধ।

সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের আলোকে, কোনো সংবাদ সংগ্রহ কার্যক্রমে বাধা দেওয়া বা হুমকি দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়ে।

জাতীয় পর্যায়ের এক গণমাধ্যম বিশ্লেষক বলেন—“সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের পথ বন্ধ করার অর্থই হলো কিছু না কিছু গোপন করার প্রয়াস। কেপিআই অজুহাত মাত্র। যদি কিছুই লুকোনোর না থাকে, তাহলে লাইভে সমস্যা কোথায়?”টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ও গণমাধ্যম অধিকার সংস্থা ‘মিডিয়া ওয়াচ বাংলাদেশ’ এই ঘটনাকে ‘মুক্ত সাংবাদিকতার ওপর নগ্ন হামলা’ আখ্যা দিয়ে বলেন—“জেলা খাদ্য কর্মকর্তা যদি নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তিনি সরাসরি সাংবাদিকদের সহায়তা দিতেন, বাধা দিতেন না।”

সাংবাদিক সমাজের দাবি:

  • ওই হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার উৎস ও অনুমোদনের তদন্ত
  • সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা
  • সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার পুনর্বহাল
  • টাঙ্গাইল খাদ্য গুদামের অনিয়ম প্রকাশে স্বচ্ছতা নিশ্চিত

সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে জনস্বার্থে দায়বদ্ধ থাকার কথা থাকলেও, কিছু কর্মকর্তার গোপনীয়তা রক্ষার নামে সাংবাদিকদের কার্যক্রমে বাধা প্রদান কেবল অনিয়মকেই প্রমাণ করে না, বরং তা সংবিধান ও জনগণের আস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এমন ঘটনায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠে—আমরা কী সত্যিই মুক্ত সাংবাদিকতার দেশে বাস করছি?

Loading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *