
মোঃ শাহজাহান বাশার,স্টাফ রিপোর্টার
ভোগান্তিতে কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কোথায়?
খুলনার মাঠ থেকে মাত্র ৫ টাকা কেজি দরে কেনা হয় বেগুন। অথচ রাজধানী ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেই একই বেগুন বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে। কৃষক বা প্রকৃত উৎপাদক এই মূল্যবৃদ্ধির এক টাকাও পান না। তাহলে এই ব্যবধান কোথায় যাচ্ছে? এর একমাত্র উত্তর—চাঁদাবাজি। পরিবহন শ্রমিকদের ভাষ্যমতে, খুলনা থেকে ঢাকায় আসার পথে অন্তত ১৯টি জায়গায় দিতে হয় চাঁদা—প্রকাশ্যে, নির্লজ্জভাবে এবং প্রায়শই পুলিশের নাকের ডগায়।
একজন পণ্যবাহী ট্রাক ড্রাইভার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন,
“খুলনা থেকে পণ্য নিয়ে বেরোলেই প্রথমেই কিছু চাঁদাবাজ লোক এসে দাঁড়ায়। তারপর একের পর এক চেকপোস্ট, পরিবহন সমিতি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, এমনকি কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও নিজেদের নামে চাঁদা দাবি করে। গড়ে প্রতি স্টপে দিতে হয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। এই খরচ কেউ দেয় না—আমরা বা মালিক মিলে পণ্যের ওপর চাপিয়ে দিই।”
এই ১৯টি চাঁদার জায়গা অতিক্রম করতে একজন ট্রাকচালককে গড়ে দিতে হয় ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ বা চাঁদা। এর সঙ্গে যোগ হয় টোল, তেল, রাতের খাবার, সহকারীর বেতন, এবং কখনো কখনো হয়রানির জন্য দেরিতে পৌঁছানোর খেসারত। সব মিলিয়ে এক ট্রাক বেগুন বা অন্যান্য সবজির দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায় রাজধানীতে পৌঁছার আগেই।
বাজারে ক্রেতারা যখন ক্ষোভ প্রকাশ করেন ‘বেগুন ৭০ টাকা কেজি কেন?’—তখন অনেকেই জানেন না, মূল উৎপাদনকারী কৃষক মাত্র ৫ টাকা কেজিতে বেগুন বিক্রি করে হতাশায় দিন কাটান। মধ্যস্বত্বভোগী ও চাঁদাবাজ চক্রই এই ব্যবধানের পুরোটা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে বলা হয় কৃষিপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাঁদাবাজির এই অদৃশ্য সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে কৃষি উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ হারাবে, ভোক্তা পাবে না সাশ্রয়ী দামে পণ্য, এবং বাজারে তৈরি হবে একটি অনিয়ন্ত্রিত মূল্য ব্যবস্থাপনা।
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কসহ দেশের প্রধান পরিবহন রুটগুলোর এই চাঁদাবাজ চিত্র প্রশাসনের অজানা নয়। প্রায়ই গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল হয়, তবু দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় না। পুলিশের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে ‘অস্বীকার’ করা হয় এসব অভিযোগ, কিংবা ‘তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’—এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায় সারাও হয়।
কৃষক মো. আক্কাস আলী বলেন,
“আমরা ৪/৫ টাকা কেজি দরে বেগুন বিক্রি করি। কিন্তু যখন শুনি ঢাকায় সেই বেগুন ৭০ টাকা বিক্রি হয়, তখন মনে হয় আমরা এই দেশে শুধু ঠকে যাওয়ার জন্যই আছি।”
সমাধান কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন:
- মাঠ পর্যায়ে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে ট্রান্সপারেন্ট মনিটরিং সেল গঠন।
- মালবাহী ট্রাকের চলাচলে নির্দিষ্ট রুট ও সরকারি মনিটরিং পয়েন্ট নির্ধারণ।
- চাঁদা আদায়ের প্রমাণ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য হটলাইন চালু।
- পণ্য পরিবহন খরচের স্বচ্ছ হিসাব ও গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ।
- চাঁদাবাজি রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
শেষ কথা: বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এখনই
দেশের সাধারণ মানুষ বাজারে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম দিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ এর বড় কারণগুলোর একটি হলো চাঁদাবাজি, যা একটি খোলা গোপন রহস্যে পরিণত হয়েছে। কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ ভোক্তা। এই সংকট নিরসনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং মিডিয়ার সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।