Dhaka 5:32 am, Saturday, 15 November 2025

মধুপুর শালবনে সংরক্ষিত অংশে অবমুক্তকরা ময়ূরগুলোর ডিম থেকে নতুন অতিথির আগমন

  • Reporter Name
  • Update Time : 06:59:51 am, Wednesday, 30 July 2025
  • 194 Time View

লিয়াকত হোসেন জনী, মধুপুর, টাঙ্গাইল  

বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল মধুপুর গড়। মধুপুর শহর ৭-৮ কিলোমিটার দূরেই এ বন। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহা সড়ক ধরে ১০ মিনিট গেলেই চোখে পড়ে এ বন । মধুপুর জাতীয় উদ্যানের মূল ফটকের সাথেই বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়।  চলার পথে রেঞ্জের দায়িত্ব থাকা মোশারফ হোসেন এর সাথে কথা বলে জানা গেল শালবনের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত।

রসুলপুর সদর রেঞ্জ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ রেঞ্জটি ১৬ হাজার ৬শ’ ৬৬ দশমিক ৬৫ একর আয়তনের। সদর,গাছাবাড়ি,লহুরিয়া,রাজাবাড়ি ও বেরিবাইদ বিট নিয়ে গঠিত রেঞ্জে এখন প্রাকৃতিক শালবন টিকে আছে মাত্র ৫ হাজার একরের মতো। এছাড়াও সামাজিক বনায়নে ১৭শ’১২ একর, বিমান বাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ ৩০৫.৪০ একর, রাবার প্রকল্পে ৭০৮ একর এবং জবরদখল রয়েছে ৩২৩২.৮৯ একরের মতো।

সাম্প্রতিক সময়ে শালবন পুনঃউদ্ধার প্রকল্পের আওতায় সীমানা চিহ্নিতকরণ, শালগাছের চারা রোপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ময়ুর ও কচ্ছপ অবমুক্ত করা হয়। গেল ২৫ মে পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা লহুরিয়া হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের ভেতরে নেটের খাঁচায় ২০ টি ময়ুর ও একই স্থানেই পুকুরে ৫৪ টি কচ্ছপ অবমুক্ত করে। দুই মাসের মধ্যে ময়ুর ডিম ও বাচ্চা দিতে শুরু করেছে। এ পর্যন্ত দুইটি বাচ্চা ও ৬ টি ডিম দিয়েছে। ডিমগুলো বাচ্চা ফুটানোর অপেক্ষায় রয়েছে।  ময়ুরের ডিম ২৮ দিন তা দেয়ার পর বাচ্চা ফোটে। এভাবে অবমুক্তকরা সব ময়ুর বাচ্চা দিতে থাকলে বাড়বে ময়ূর। পরে বনে অবমুক্ত করা হলে মধুপুর বনে আবার পেখম খোলে নাচবে ময়ুর এমনটাই আশা সংশ্লিষ্টদের।

১০ হাজার বর্গ ফুটের চিড়িয়াখানার আদলে করা খাঁচা জিআই নেটের বেড়া। এর মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করা ময়ুরগুলোকে প্রতিদিন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইন্সের মাধ্যমে দেখাশোনা করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে এখন পর্যন্ত কোন অসুখ বিসুখ দেখা দেয়নি। আম,গাজর,মুরগির ফিড,গম,ন্যাচারাল পিঁপড়ার ডিমসহ নানা ধরনের খাবার দেয়া হচ্ছে। এসব তথ্য রসুলপুর রেঞ্জ অফিস থেকে পাওয়া গেছে।

সরজমিনেে দেখা যায়  লহুরিয়া হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের দেয়াল ঘেঁষা সংরক্ষিত অংশের ভেতরে ময়ুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারদিকে ও উপরেও নেট। ভেতরে তাক বানানো। বৃষ্টি হলে ময়ুরগুলো তাকে উঠে।সুন্দর পরিবেশ। দেখে মনে হলো কোন ডিস্টার্ব নেই।নিরিবিলি পরিবেশেই ময়ুরগুলো ডিমও বাচ্চা দিচ্ছে।

পরে টেলকি,রসুলপুর,গায়রা,কাঁকড়াগুণিসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল এবং জীব বৈচিত্রের দিক দিয়ে বেশ সমৃদ্ধ ছিল। বন ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণী অনেকটাই কমে গেছে। মধুপুর জাতীয় উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী, হরেক প্রজাতির পাখি ও নানা প্রজাতির সরিসৃপ পাওয়া যেত। এর মধ্যে মুখপোড়া হনুমান, লালমুখ বানর, মায়া হরিণ, শজারু, বুনো শুকর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে রয়েছে মেঘ হু, মাছরাঙা, খয়ড়া গোছা পেঁচা, বনমোরগ প্রভৃতি। এছাড়া, পূর্বে মধুপুর গড়ে হাতি, বাঘ, চিতা ও ময়ূরের মত প্রাণীর বিচরণ ছিল বলে জানা গেছে। এ বনের হারিয়ে যাওয়া ময়ূর আবার ফিরে আসলে বাড়বে প্রাণী বৈচিত্র্য। মধুপুর বন ফিরে পাবে তার হারনো গৌরব আর আদি ঐতিহ্য এমন মনে করেছে স্থানীয়রা ।

টাঙ্গাইল বনবিভাগের রসুলপুর সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন জানান, শালবন পুনঃউদ্ধার কার্যক্রম চলমান। শালগজারি ও শালসহযোগি বহেড়া, নিম,হরতকিসহ বিভিন্ন দেশি প্রজাতির বৃক্ষ রোপন করা হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার লহুরিয়ায় অবমুক্ত করা ময়ুর ইতিমধ্যে দুইটি বাচ্চা ও ৬ টি ডিম দিয়েছে। ডিমগুলো বাচ্চা ফোটানোর অপেক্ষায় রয়েছে। বর্ষা মৌসুমের পর হয়তো আরও ভালো উপযোগী পরিবেশ হবে তখন সবগুলো ডিম বাচ্চা দেয়া শুরু করলে ময়ূরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।  এভাবে বনে অবমুক্ত করার মধ্যে দিয়ে এ বন হারনো ময়ুর আবার ফিরে পাবে বলে তিনি মনে করেন।

তবে স্থানীয়রা মনে করছে সামাজিক বনায়নে শালগজারি বৃক্ষ রোপণের মধ্যে দিয়ে টেকসই বন ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশ গ্রহণে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে এসে শালবনের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে  আনা দরকার বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ হ্রাস,  বাণিজ্যিক চাষাবাদে নিরুৎসাহিত করা এবং প্রাকৃতিক বন গড়ে তোলার দিকে গুরুত্ব বৃদ্ধি করলে  মধুপুর গড় পুনরায় এর পূর্বের রূপ ও ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে জানান এ গড়াঞ্চলের  অধিবাসীরা।

Tag :
সম্পাদক ও প্রকাশক : আবুল হাসান

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়

নরসিংদী সদর উপজেলার কাঁঠালিয়া ইউনিয়ন এর সাবেক চেয়ারম্যান বীনা গ্রেপ্তার

মধুপুর শালবনে সংরক্ষিত অংশে অবমুক্তকরা ময়ূরগুলোর ডিম থেকে নতুন অতিথির আগমন

Update Time : 06:59:51 am, Wednesday, 30 July 2025

লিয়াকত হোসেন জনী, মধুপুর, টাঙ্গাইল  

বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল মধুপুর গড়। মধুপুর শহর ৭-৮ কিলোমিটার দূরেই এ বন। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহা সড়ক ধরে ১০ মিনিট গেলেই চোখে পড়ে এ বন । মধুপুর জাতীয় উদ্যানের মূল ফটকের সাথেই বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়।  চলার পথে রেঞ্জের দায়িত্ব থাকা মোশারফ হোসেন এর সাথে কথা বলে জানা গেল শালবনের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত।

রসুলপুর সদর রেঞ্জ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ রেঞ্জটি ১৬ হাজার ৬শ’ ৬৬ দশমিক ৬৫ একর আয়তনের। সদর,গাছাবাড়ি,লহুরিয়া,রাজাবাড়ি ও বেরিবাইদ বিট নিয়ে গঠিত রেঞ্জে এখন প্রাকৃতিক শালবন টিকে আছে মাত্র ৫ হাজার একরের মতো। এছাড়াও সামাজিক বনায়নে ১৭শ’১২ একর, বিমান বাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ ৩০৫.৪০ একর, রাবার প্রকল্পে ৭০৮ একর এবং জবরদখল রয়েছে ৩২৩২.৮৯ একরের মতো।

সাম্প্রতিক সময়ে শালবন পুনঃউদ্ধার প্রকল্পের আওতায় সীমানা চিহ্নিতকরণ, শালগাছের চারা রোপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ময়ুর ও কচ্ছপ অবমুক্ত করা হয়। গেল ২৫ মে পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা লহুরিয়া হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের ভেতরে নেটের খাঁচায় ২০ টি ময়ুর ও একই স্থানেই পুকুরে ৫৪ টি কচ্ছপ অবমুক্ত করে। দুই মাসের মধ্যে ময়ুর ডিম ও বাচ্চা দিতে শুরু করেছে। এ পর্যন্ত দুইটি বাচ্চা ও ৬ টি ডিম দিয়েছে। ডিমগুলো বাচ্চা ফুটানোর অপেক্ষায় রয়েছে।  ময়ুরের ডিম ২৮ দিন তা দেয়ার পর বাচ্চা ফোটে। এভাবে অবমুক্তকরা সব ময়ুর বাচ্চা দিতে থাকলে বাড়বে ময়ূর। পরে বনে অবমুক্ত করা হলে মধুপুর বনে আবার পেখম খোলে নাচবে ময়ুর এমনটাই আশা সংশ্লিষ্টদের।

১০ হাজার বর্গ ফুটের চিড়িয়াখানার আদলে করা খাঁচা জিআই নেটের বেড়া। এর মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করা ময়ুরগুলোকে প্রতিদিন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইন্সের মাধ্যমে দেখাশোনা করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে এখন পর্যন্ত কোন অসুখ বিসুখ দেখা দেয়নি। আম,গাজর,মুরগির ফিড,গম,ন্যাচারাল পিঁপড়ার ডিমসহ নানা ধরনের খাবার দেয়া হচ্ছে। এসব তথ্য রসুলপুর রেঞ্জ অফিস থেকে পাওয়া গেছে।

সরজমিনেে দেখা যায়  লহুরিয়া হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের দেয়াল ঘেঁষা সংরক্ষিত অংশের ভেতরে ময়ুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারদিকে ও উপরেও নেট। ভেতরে তাক বানানো। বৃষ্টি হলে ময়ুরগুলো তাকে উঠে।সুন্দর পরিবেশ। দেখে মনে হলো কোন ডিস্টার্ব নেই।নিরিবিলি পরিবেশেই ময়ুরগুলো ডিমও বাচ্চা দিচ্ছে।

পরে টেলকি,রসুলপুর,গায়রা,কাঁকড়াগুণিসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল এবং জীব বৈচিত্রের দিক দিয়ে বেশ সমৃদ্ধ ছিল। বন ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণী অনেকটাই কমে গেছে। মধুপুর জাতীয় উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী, হরেক প্রজাতির পাখি ও নানা প্রজাতির সরিসৃপ পাওয়া যেত। এর মধ্যে মুখপোড়া হনুমান, লালমুখ বানর, মায়া হরিণ, শজারু, বুনো শুকর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে রয়েছে মেঘ হু, মাছরাঙা, খয়ড়া গোছা পেঁচা, বনমোরগ প্রভৃতি। এছাড়া, পূর্বে মধুপুর গড়ে হাতি, বাঘ, চিতা ও ময়ূরের মত প্রাণীর বিচরণ ছিল বলে জানা গেছে। এ বনের হারিয়ে যাওয়া ময়ূর আবার ফিরে আসলে বাড়বে প্রাণী বৈচিত্র্য। মধুপুর বন ফিরে পাবে তার হারনো গৌরব আর আদি ঐতিহ্য এমন মনে করেছে স্থানীয়রা ।

টাঙ্গাইল বনবিভাগের রসুলপুর সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন জানান, শালবন পুনঃউদ্ধার কার্যক্রম চলমান। শালগজারি ও শালসহযোগি বহেড়া, নিম,হরতকিসহ বিভিন্ন দেশি প্রজাতির বৃক্ষ রোপন করা হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার লহুরিয়ায় অবমুক্ত করা ময়ুর ইতিমধ্যে দুইটি বাচ্চা ও ৬ টি ডিম দিয়েছে। ডিমগুলো বাচ্চা ফোটানোর অপেক্ষায় রয়েছে। বর্ষা মৌসুমের পর হয়তো আরও ভালো উপযোগী পরিবেশ হবে তখন সবগুলো ডিম বাচ্চা দেয়া শুরু করলে ময়ূরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।  এভাবে বনে অবমুক্ত করার মধ্যে দিয়ে এ বন হারনো ময়ুর আবার ফিরে পাবে বলে তিনি মনে করেন।

তবে স্থানীয়রা মনে করছে সামাজিক বনায়নে শালগজারি বৃক্ষ রোপণের মধ্যে দিয়ে টেকসই বন ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশ গ্রহণে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এগিয়ে এসে শালবনের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে  আনা দরকার বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ হ্রাস,  বাণিজ্যিক চাষাবাদে নিরুৎসাহিত করা এবং প্রাকৃতিক বন গড়ে তোলার দিকে গুরুত্ব বৃদ্ধি করলে  মধুপুর গড় পুনরায় এর পূর্বের রূপ ও ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে জানান এ গড়াঞ্চলের  অধিবাসীরা।