Dhaka 8:11 am, Thursday, 6 November 2025

হাসিনাকে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিতে নিষেধ করেছে ভারত

  • Reporter Name
  • Update Time : 11:31:24 am, Wednesday, 8 October 2025
  • 199 Time View
মোঃ শাহজাহান বাশার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
ভারত সরকার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছে— এমন চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন ভারতের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক ড. রাধা দত্ত। তার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের অবস্থান একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা আগের নীতিমালা থেকে “কিছুটা ভিন্ন ও সতর্কতামূলক”।

ভারতের এই দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ বলেন,“শেখ হাসিনাকে আগের মতো রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখছে ভারত। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারকেরা এখন নতুন করে ভাবছেন। সম্পর্কের বাস্তবতায় তারা বুঝতে পারছেন, আগের মতো একতরফা সমর্থন আর সম্ভব নয়।”তিনি আরও বলেন,“বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পরের পরিস্থিতি নিয়ে শেখ হাসিনার একের পর এক মন্তব্য ভারতের জন্যও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। দিল্লি মনে করছে— এ ধরনের বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্ককে উত্তপ্ত করতে পারে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে।”

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিজের মতো করে রাজনৈতিক বয়ান দিচ্ছেন। এই বয়ানগুলোতে তিনি অভ্যুত্থান, প্রশাসনিক পরিবর্তন, এবং বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন— যা ঢাকা ও দিল্লি উভয় মহলেই অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহ বিভিন্ন রাজনীতিক এ ধরনের বক্তব্যকে “পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা” হিসেবে দেখছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জুলাই মাসে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানায়— তাকে যেন রাজনৈতিক কার্যক্রম বা বক্তব্য থেকে বিরত রাখা হয়।তবে তখন পর্যন্ত ভারতের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শেখ হাসিনার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যক্রম ও প্রকাশ্য মন্তব্য হঠাৎ কমে গেছে, যা বিশ্লেষকদের মতে দিল্লির ‘নীরব বার্তা’রই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্রী রাধা দত্ত বলেন,“আমার বিশ্বাস, দিল্লি এখন চায় না যে শেখ হাসিনা এমন কোনো বক্তব্য দিন, যা বাংলাদেশে সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উত্তেজনা বা ভারতবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করবে। ভারত চায়— সম্পর্কটিকে একটি বাস্তবিক ও নিরাপত্তাভিত্তিক প্রেক্ষাপটে ধরে রাখতে।”তিনি আরও বলেন,“বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও এখন ভারতের কাছে নিশ্চয়তা দিতে হবে— বাংলাদেশ ভারতের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি নয়। এই সমঝোতাই ভবিষ্যতের সম্পর্ক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আব্দুল হাই মনে করেন,“ভারতের এই পদক্ষেপ তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দেয়। অতীতে তারা শেখ হাসিনার সরকারকে সব সময় নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তারা বাস্তবতার আলোকে নতুন নীতি গ্রহণ করছে।”তিনি আরও বলেন,“তবে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি এখনো ভারতের জন্য রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। ভবিষ্যতে সেটি নির্ভর করবে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের প্রকৃতির উপর।”

দিল্লি ও ঢাকা— উভয় কূটনৈতিক মহলে এখন গুঞ্জন, ভারতের কৌশলগত নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘ব্যালান্সড পজিশন’ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এটি এমন এক সময়ের ইঙ্গিত, যখন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও দক্ষিণ এশীয় নিরাপত্তা কাঠামো ও প্রতিবেশী দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বরাবরই বাস্তববাদী রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারতের ‘নীরব সতর্কতা’ ও ‘বক্তব্য নিয়ন্ত্রণের কৌশল’ ইঙ্গিত দিচ্ছে— দিল্লি এখন শুধু বন্ধুত্ব নয়, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের রাজনীতিকেও অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
শেখ হাসিনার বক্তব্যে লাগাম টানার এই পদক্ষেপ হয়তো ভারতের জন্য তাৎক্ষণিক স্থিতি আনবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা দুই দেশের রাজনৈতিক আস্থার ওপর কী প্রভাব ফেলবে— সেটিই এখন কূটনৈতিক অঙ্গনের বড় প্রশ্ন।

Tag :
সম্পাদক ও প্রকাশক : আবুল হাসান

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়

সাতক্ষীরা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর গৃহবধূর মৃত্যু

হাসিনাকে বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিতে নিষেধ করেছে ভারত

Update Time : 11:31:24 am, Wednesday, 8 October 2025
মোঃ শাহজাহান বাশার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
ভারত সরকার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছে— এমন চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন ভারতের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক ড. রাধা দত্ত। তার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের অবস্থান একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা আগের নীতিমালা থেকে “কিছুটা ভিন্ন ও সতর্কতামূলক”।

ভারতের এই দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ বলেন,“শেখ হাসিনাকে আগের মতো রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখছে ভারত। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারকেরা এখন নতুন করে ভাবছেন। সম্পর্কের বাস্তবতায় তারা বুঝতে পারছেন, আগের মতো একতরফা সমর্থন আর সম্ভব নয়।”তিনি আরও বলেন,“বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পরের পরিস্থিতি নিয়ে শেখ হাসিনার একের পর এক মন্তব্য ভারতের জন্যও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। দিল্লি মনে করছে— এ ধরনের বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্ককে উত্তপ্ত করতে পারে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে।”

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিজের মতো করে রাজনৈতিক বয়ান দিচ্ছেন। এই বয়ানগুলোতে তিনি অভ্যুত্থান, প্রশাসনিক পরিবর্তন, এবং বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন— যা ঢাকা ও দিল্লি উভয় মহলেই অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহ বিভিন্ন রাজনীতিক এ ধরনের বক্তব্যকে “পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা” হিসেবে দেখছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জুলাই মাসে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানায়— তাকে যেন রাজনৈতিক কার্যক্রম বা বক্তব্য থেকে বিরত রাখা হয়।তবে তখন পর্যন্ত ভারতের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শেখ হাসিনার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যক্রম ও প্রকাশ্য মন্তব্য হঠাৎ কমে গেছে, যা বিশ্লেষকদের মতে দিল্লির ‘নীরব বার্তা’রই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্রী রাধা দত্ত বলেন,“আমার বিশ্বাস, দিল্লি এখন চায় না যে শেখ হাসিনা এমন কোনো বক্তব্য দিন, যা বাংলাদেশে সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উত্তেজনা বা ভারতবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করবে। ভারত চায়— সম্পর্কটিকে একটি বাস্তবিক ও নিরাপত্তাভিত্তিক প্রেক্ষাপটে ধরে রাখতে।”তিনি আরও বলেন,“বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও এখন ভারতের কাছে নিশ্চয়তা দিতে হবে— বাংলাদেশ ভারতের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি নয়। এই সমঝোতাই ভবিষ্যতের সম্পর্ক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আব্দুল হাই মনে করেন,“ভারতের এই পদক্ষেপ তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দেয়। অতীতে তারা শেখ হাসিনার সরকারকে সব সময় নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তারা বাস্তবতার আলোকে নতুন নীতি গ্রহণ করছে।”তিনি আরও বলেন,“তবে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি এখনো ভারতের জন্য রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। ভবিষ্যতে সেটি নির্ভর করবে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের প্রকৃতির উপর।”

দিল্লি ও ঢাকা— উভয় কূটনৈতিক মহলে এখন গুঞ্জন, ভারতের কৌশলগত নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘ব্যালান্সড পজিশন’ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এটি এমন এক সময়ের ইঙ্গিত, যখন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও দক্ষিণ এশীয় নিরাপত্তা কাঠামো ও প্রতিবেশী দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বরাবরই বাস্তববাদী রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারতের ‘নীরব সতর্কতা’ ও ‘বক্তব্য নিয়ন্ত্রণের কৌশল’ ইঙ্গিত দিচ্ছে— দিল্লি এখন শুধু বন্ধুত্ব নয়, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের রাজনীতিকেও অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
শেখ হাসিনার বক্তব্যে লাগাম টানার এই পদক্ষেপ হয়তো ভারতের জন্য তাৎক্ষণিক স্থিতি আনবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা দুই দেশের রাজনৈতিক আস্থার ওপর কী প্রভাব ফেলবে— সেটিই এখন কূটনৈতিক অঙ্গনের বড় প্রশ্ন।