গোপালগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ত্রিপল্লী শেখ আবু নাসের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিয়োগ জালিয়াতি ও দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ে বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক উৎপলা বিশ্বাসের স্থলে জাল রেজুলেশন তৈরি করে অন্য এক নারী সুতৃষ্ণা বরকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে সরকারি বেতন তোলার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পত্রিকায় গণিত ও সমাজবিজ্ঞান (বাংলা) বিষয়ে দুটি শূন্য পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে গণিতে সুশান্ত মালাকার এবং বাংলা বিষয়ে উৎপলা বিশ্বাস প্রথম স্থান অর্জন করেন। যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাঁরা ২৯ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং ৩ মে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। উৎপলা বিশ্বাস প্রায় দুই বছর পাঠদান শেষে ২০১৬ সালের জুন মাসে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ায় ৭ জুন বিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি নেন। এরপর থেকে বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ে পদটি শূন্য ছিল।
অভিযোগ রয়েছে, প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি বিশ্বাস পরবর্তীতে ওই শূন্য পদে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে পূর্বের রেজুলেশন পরিবর্তন করেন। তৎকালীন সভাপতি, শিক্ষক ও অভিভাবক সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করে উৎপলা বিশ্বাস-এর স্থলে সুতৃষ্ণা বর নামে নতুন রেজুলেশন তৈরি করেন এবং বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ভুয়া নিয়োগপত্র ও যোগদানপত্র প্রস্তুত করেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের সহযোগিতায় সুতৃষ্ণা বরকে সরকারি এমপিও বেতন সিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
গণিত বিষয়ে বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক সুশান্ত মালাকার বলেন, বৈধ নিয়োগকে অবৈধ করার বিষয়ে আমি জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি
অভিযোগের সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রমাণপত্রও জমা দিয়েছি। আমি এবং উৎপলা বিশ্বাস যথাযথ নিয়মে ২০১৪ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত হই। কিন্তু প্রধান শিক্ষক জাল স্বাক্ষর ব্যবহার করে আমাদের মূল রেজুলেশন পরিবর্তন করে সুতৃষ্ণা বরের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে আমাদের বৈধ নিয়োগও আইনি ঝুঁকিতে পড়েছে। আমি এই ঘটনার সঠিক তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দাবি করছি।
বাংলা বিষয়ে বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত উৎপলা বিশ্বাস বলেন, আমি প্রায় দুই বছর চাকরি করার পর ২০১৬ সালের জুন মাসে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি হওয়ায় অব্যাহতি নেই। এরপর বিদ্যালয়ের আর কোনো খবর রাখিনি এবং এ বিষয়ে কিছু জানতেও চাই না।সিনিয়র শিক্ষক শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন,২০২২ সালে বিদ্যালয়ের এমপিও ফাইল যাচাইয়ের সময় দেখি সুতৃষ্ণা বর নামে এক শিক্ষকের নাম রয়েছে। অথচ আগের সার্কুলারে ছিল সুশান্ত স্যার ও উৎপলা বিশ্বাস ম্যাডামের নাম। সুতৃষ্ণা বর কোথা থেকে এলো, আমরা কেউ জানি না।সহকারী শিক্ষক রমা নাথ বৈরাগী বলেন, যখন সুশান্ত স্যার ও উৎপলা ম্যাডামের নিয়োগ হয়েছিল, তখন আমরা জানতাম। কিন্তু পরবর্তীতে নতুন করে কোনো নিয়োগ হয়েছে কি না, সেটি আমাদের অজানা।শিক্ষক বিউটি রানী মণ্ডল বলেন, সুতৃষ্ণা বর নামে কাউকে আমরা আগে দেখিনি। সাম্প্রতিক কয়েক দিন ধরে তাকে বিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে। কীভাবে তিনি এখানে নিয়োগ পেলেন, তা জানি না।অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি বিশ্বাস এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। সাংবাদিকরা বিদ্যালয়ে গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎ না পেয়ে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। পরে তিনি ফোন বন্ধ করে দেন। এমনকি বাড়িতে গিয়ে সাংবাদিকরা উপস্থিত হলে তিনি সেখান থেকেও চলে যান বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য ও জালিয়াতির অভিযোগ সম্পর্কে আমি অবগত নই। কোনো ভুক্তভোগী আমার কাছে লিখিত অভিযোগও করেনি। তবে সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। যদি অভিযোগ সত্য হয়, এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব।
অভিযুক্ত সুতৃষ্ণা বর বলেন, ২০১৪ সালে আমি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিই এবং তাতে উত্তীর্ণ হই। তখন স্কুল এমপিওভুক্ত না থাকায় চাকরিতে যোগ দিইনি। কর্তৃপক্ষ বলেছিল পরে জানাবে। প্রায় সাত বছর পর ২০২২ সালে আমাকে পুনরায় বিদ্যালয়ে যোগ দিতে বলা হয় এবং তখন থেকে আমি বেতন পাচ্ছি। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কী ঘটেছে, সেটা আমি জানি না সেটা কর্তৃপক্ষ জানে।তাঁর নিয়োগ রেজুলেশনে কার স্বাক্ষর রয়েছে জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে চলে যান।উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) সেলিম তালুকদার বলেন, আমি সম্প্রতি এখানে অতিরিক্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। এ বিষয়ে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে সত্য উদঘাটন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আক্তার বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে প্রাথমিক অনুসন্ধান করা হবে। প্রমাণ মিললে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।ত্রিপল্লী শেখ আবু নাসের মাধ্যমিক বিদ্যালয় উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হলেও সাম্প্রতিক নিয়োগ জালিয়াতির অভিযোগে শিক্ষক ও অভিভাবক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।