
মো: শাহজাহান বাশার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠনের আদেশ আজ (রোববার, ২ নভেম্বর) ঘোষণা করা হবে।
ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল আজ এ আদেশ দেবেন। অন্য দুই সদস্য হলেন– অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
প্রসিকিউশন সূত্রে জানা যায়, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনের নামে কুষ্টিয়ায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গণগ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনায় হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর প্রসিকিউশন এ অভিযোগপত্র দাখিল করে ট্রাইব্যুনালে। পরবর্তীতে শুনানিতে এসব অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করেন এবং কারাগার থেকে ইনুকে হাজিরের নির্দেশ দেন।
গত ২৮ অক্টোবর ইনুর পক্ষে আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী অভিযোগগুলোর কিছু অংশ পড়ে শোনান এবং বলেন, “এই অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা।” তিনি অভিযোগ খারিজের আবেদন করেন এবং আদালতকে প্রতিটি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনার অনুরোধ জানান।
তবে প্রসিকিউশন দাবি করে, ‘১৪ দলীয় জোটের শরিক’ হিসেবে ইনু কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ইনুর আলোচনার মাধ্যমেও ‘কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ বা নেতৃত্বের দায় প্রমাণ হয়।
প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম গত ২৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে ইনুর বিরুদ্ধে আনা আটটি অভিযোগ পড়ে শোনান। তিনি বলেন, “ইনু সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন।”
প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, আবদুস সোবহান তরফদার, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অনেকে।
ইনুর পক্ষে আইনজীবী নাজনীন নাহার অভিযোগপত্রের বিশালতা উল্লেখ করে বলেন, “এই মামলায় মোট ১৭০০ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র রয়েছে। সেগুলো পড়া এবং আসামির সঙ্গে আলোচনা করতে আমাদের আট সপ্তাহ সময় প্রয়োজন।”
ট্রাইব্যুনাল তার আবেদন আংশিক মঞ্জুর করে ইনুর সঙ্গে তিন দিন, প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে প্রিভিলেজ কমিউনিকেশনের অনুমতি দেন।
একই দিনে অন্য মামলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এবং কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খান, সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী এবং শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা– এ চারজনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ গঠনের আদেশ হবে।
তাদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য, ষড়যন্ত্র ও কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যার তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই মামলায় আসামিরা পলাতক থাকায় আদালত তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন নিয়োগ দেন। তিনি অভিযোগ খারিজের আবেদন জানিয়ে বলেন, “প্রসিকিউশন ফরমাল চার্জে যে পটভূমি দিয়েছে, তা ভিত্তিহীন ও অসঙ্গত।”
তবে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম যুক্তি দেন, “হানিফ ও তার সহযোগীরা কুষ্টিয়ায় পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড ছিল সরাসরি উস্কানিমূলক, যা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।”
১৪ অক্টোবর চার আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু হাজির না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং দুইটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দেওয়া হয়।
এর আগে ৬ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল-২ হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে সারা দেশে ছাত্র ও জনতার আন্দোলন দমন অভিযানে কুষ্টিয়ায় ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ঘটে। ওই সময় ছয়জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হন।
এই হত্যাকাণ্ডের পর ভুক্তভোগীদের পরিবার মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইনু ও হানিফের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়।
হাসানুল হক ইনু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তবে সাম্প্রতিক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-২ আসনে জোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন।
গত বছরের ২৬ আগস্ট রাজধানীর উত্তরা থেকে ইনুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি একাধিক মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
আজকের শুনানিতে যদি ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন, তবে ইনু, হানিফসহ সংশ্লিষ্ট আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হবে।
এই আদেশ বাংলাদেশের রাজনীতি ও ন্যায়বিচারের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
Reporter Name 
























