বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে সাংবাদিকতা কতটুকু স্বাধীন
মোঃ হৃদয় হাসান সাকিব, স্টাফ রিপোর্টার
সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ, গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ নানাবিধ দাবী সাংবাদিকরা ঘুগের পর ঘুগ থেকে অব্যহত রখেছে । কিন্ত আজও বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠাতা লাভ করেনি। তবুও আমরা আমাদের আন্দোলন অভ্যহত রয়েছে।বাংলাদেশে দুর্নীতি, চুরি, পাচার, মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধেও এতো আইন নেই, যতোটা সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে রয়েছে। নানা আইনে সাংবাদিকদের একেবারে নাজেহাল করছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ সাধিত হয়েছে। তবে ১৯৯০-পরবর্তী গণতান্ত্রিক যুগের সূচনায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমকাঠামো, বিষয়বস্তু, ব্যবহার ও মালিকানায় নানা পরিবর্তন দেখা যায়। নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ও বিশ্বায়নের অনস্বীকার্য প্রভাবে এ দেশের সংবাদমাধ্যমও প্রভাবিত হয়েছে। রাজনৈতিক যাতাকলে গণমাধ্যম এক প্রকার কোনঠাসা হয়ে রয়েছে। দূর্নীতিবাজরা এখন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রীয় নানা আইনি ও নীতিকাঠামো এবং এর ফলস্বরূপ ‘সেলফ সেন্সরশিপ’-এর মতো নানা চ্যালেঞ্জের কারণে পেশাদার ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চা নিবিড় হয়নি। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় নানা আইনি ও নীতিকাঠামো বর্তমানে সংবাদমাধ্যম ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বিশেষ প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। এসব আইন যেকোনো সময় যেকোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবহারের হুমকি সাংবাদিকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
আর এই সব চ্যালেঞ্জ সাংবাদিকরা সব সময় মোকাবেলা করে থাকেন। তাও আবার বিনা বেতনে এক কথায় বাড়ির খেয়ে বোনের মহিশ তাড়ানোর মতো। আমি জানি
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩, এবং পেনাল কোড ১৮৬০-এর বিভিন্ন ধারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের উদাহরণ আছে। এ সব আইনে অনেক সাংবাদিক সাজা ভোগ করেছেন। এসব আইনে ব্যক্তির মানহানি, মিথ্যা তথ্য প্রকাশ, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা লঙ্ঘন কিংবা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর বিবেচনায় মামলা করার সুযোগ আছে। তবুও সব সমস্যা মোকাবেলা করে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা কোন রকম চালিয়ে যাচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, আগের আইসিটি আইন ২০১৩-এর অধীনে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ ১ হাজার ৩০০ মামলা নথিবদ্ধ করে, যার বেশির ভাগই বিতর্কিত ৫৭ ধারায় করা। এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর অধীনে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে (সূত্র: ৫ জুন ২০২৩-এ জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক)। অর্থাৎ এই আইনের অধীন প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চারটি মামলা হয়েছে।আমি মনে করি সাংবাদিকতা, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও বাক্স্বাধীনতা অবাধ করতে অবিলম্বে দণ্ডবিধি ১৮৬০-সহ সংশ্লিষ্ট সব আইন ও বিধি, বিশেষ করে সাইবার নিরাপত্তা আইন, খসড়া গণমাধ্যমকর্মী আইন ঢেলে সাজানো এবং আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রণয়ন কিংবা পুনঃপ্রণয়ন জরুরি। বিশেষ করে সাংবাদিকতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য হুমকি অব্যহত রয়েছে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে । শুক্রবার (৩ মে) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৪ সালের এই সূচক প্রকাশ করেছে। সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম, স্কোর ২৭ দশমিক ৬৪। ২০২৩ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৩তম। স্কোর ছিল ৩৫ দশমিক ৩১।সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের বড় অবনমন ঘটেছিল ২০২২ সালে। ২০২১ সালের তুলনায় ওই বছর সূচকে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনমন হয়েছিল। পরের বছর আরও এক ধাপ পেছায় বাংলাদেশ। আর এবার দুই ধাপ পিছিয়েছে। সে হিসেবে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে তিন বছরে সূচকে বাংলাদেশের ১৩ ধাপ অবনমন ঘটল, ১৫২তম থেকে ১৬৫তম অবস্থানে নেমে গেল বাংলাদেশ।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ওপর ভিত্তি করে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তা—এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক তৈরি করা হয়। গত বছরের তুলনায় সামাজিক ও নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলেও বাকি তিনটি ক্ষেত্রে অবনমন হয়েছে।বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার আলোচনায় আরএসএফ বলেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি নাগরিকের মধ্যে এক–পঞ্চমাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাদের সংযোগ সামান্য। সংবাদ ও তথ্য ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকা বাড়ছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সকল সদস্য দেশ এবং এর নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেমনটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৌলিক অধিকারের সনদের পাশাপাশি মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় কনভেনশনে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। ফলে এখন বলার অপেক্ষা রাখানা স্বাধীন সাংবাদিকতায় আমরা কতোটা পিছিয়ে রয়েছি।
দেশের সাংবিধানে সাংবাদিকদের অধিকার দেওয়া হয়েছে কিন্ত আমরা কেন সেই অকিার থেকে আজও বঞ্চিত রয়েছি। সাংবিধানের ২৯/১ ধারায় রয়েছে (১) প্রত্যেক নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। (২) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে। পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা: আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি সঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসা পরিচালনার অধিকার থাকবে। কিন্ত সাংবাদিকরা সে সব সুযোগ পাচ্ছেন? সাংবাদিকতা সত্যকে প্রচার করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবাধিকার সংরক্ষণ, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধাচারণ, দুর্বল জনগোষ্ঠীর পক্ষধারণসহ নৈতিকতার ভিত্তি আছে বলে এ পেশা সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের পথে সমাজকে এগিয়ে নেয়, অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোতে মানুষে মানুষে, গোত্রে গোত্রে, বর্ণে বর্ণে, ধর্মে ধর্মে বিভেদকারীর সংখ্যা নগণ্য নয়। এ বিভেদ কখনো ইতিহাস আশ্রিত, কখনো ভূখণ্ডগত, ধর্মগত, কখনো আবার লিঙ্গ ও ভাষাগত। অবশ্য কারও কারও কাছে এ বিভেদ তেজারতি বা রাজনীতি। ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’-দুর্ভাগ্যক্রমে এটিই কারও কারও দৃষ্টিভঙ্গি! অথচ কে না জানি, এ বিভেদ যত বাড়ে ততই ব্যক্তিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক প্রগতি বিনষ্ট হয়-মানবতা ততই প্রার্থিত প্রগতি থেকে পিছিয়ে পড়ে। ফলে গণমাধ্যমে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমার বিশ্বাস, বস্তুনিষ্ঠ ও শান্তিবাদী সাংবাদিকতা এ প্রেক্ষাপটে যোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে দেশের সকল উন্নয়নে এবং অপরাধীদের মুখোশ উন্মচন করতে। কারণ নৈতিকতাসম্পন্ন বলিষ্ঠ সাংবাদিকতা একদিকে যেমন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সরবরাহ করে, নেতিবাচক বিষয়েই কেবল সীমাবদ্ধ থাকে না, থাকতে হয় তাকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং নিরপেক্ষ পর্যালোচনায় সমাজকে শিক্ষিত ও দায়িত্ববান করার দায়িত্বেও। অন্য সব পেশা থেকে সাংবাদিকতা পেশার স্বাতন্ত্র্য । এবং ঝুকিপূর্ণ ফলে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার একান্ত প্রয়োজন। দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম মানুষের অধিকার ও গর্ব । রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, গোত্রে গোত্রে, সংঘাত-সংঘর্ষ বা যুদ্ধে নাগরিক দেশ বা গোত্রভুক্ত হবেন-এটিই মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, যে সাংবাদিকতা মানুষকে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন করে, যা বিবেক জাগ্রত করে, সঠিক সত্য উপস্থাপন করে, সে সাংবাদিকতা নিছক ‘দেশ ও জাতিপ্রেমিকতার আবেগ’ আবদ্ধ হলে, পক্ষভুক্ত হলে সত্যানুসন্ধান ও শান্তির স্বার্থে তা কতটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদপত্রকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় সংবাদপত্র সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করে। কিন্তু এই সংজ্ঞার বিপরীত রূপ দেখা যায় সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হামলার খবরে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সত্য, শান্তি, সৌহার্দ ও মানবাধিকারের স্বার্থে সাংবাদিকতার যোগ্য ভূমিকা নিরূপণের যে সুযোগ বিদ্যমান তার উপযুক্ত ব্যবহার প্রয়োজন। এসব বিষয়ে আমরা কে কতটা পারবো বা পারবো না তা তাদের নিজস্ব চেতনা ও সামর্থ্যরে ব্যাপার। কিন্তু এ সত্য কখনোই অনস্বীকার্য নয় যে, সাংবাদিকতা সত্য ও শান্তির স্বার্থে ভূমিকা রাখার উপযুক্ত বাহন। অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীন সাংবাদিকতা ও নিরাপদ সাংবাদিকরা এক সময় মাথ উচু করে দাঁড়াবে।
লেখক ও গবেষক :
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি
ঢাকা প্রেস ক্লাব