শুভ হোক মহামান্যের মহাকাব্যিক যাত্রা
নিজস্ব প্রতিবেদক
ক্ষণকালের এ জীবনকে মহিমান্বিত করার সুযোগ পৃথিবীতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন খুব কম মানুষকেই দেন। নিজ কর্মগুণে যারা পৃথিবীতে আলোকধারা রেখে গেছেন, তাদেরই পদাংঙ্ক অনুসরণ করে আজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নতুন মহামান্য রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করবেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। সত্যিকার অর্থেই আজকের এই দিনটি তাঁর জীবনের পরমতম মাহেন্দ্রক্ষণ হিসাবেই বিবেচ্য। বাংলাদেশের প্রথম নাগরিক হিসাবে তিনি তাঁর সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা দিয়ে দেশকে আরো উন্নত ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটাই প্রত্যাশা।
মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, ঠিক আগের মতোই তিনি সমাজের সকল স্তরের মানুষের সাথে দেখা করছেন, কথা বলছেন; অনেক সময় নিজ থেকেই খোঁজ খবর নিয়েছেন নানা জনের। এ প্রসঙ্গে তিনি খুব সুস্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন, ‘আমি জনগণের রাষ্ট্রপতি। জনগণের সাথেই আমার সকল কাজ। ’
আজ থেকে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।
ভালোবাসায় বড় হয়েছি।
বাংলাদেশের সক্ষমতার পরিচায়ক স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাহারের সময় তিনি একজন দেশপ্রেমিক সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে নিজের আদর্শিক লড়াই চালিয়ে গেছেন খুব দৃঢ়তা নিয়ে। নিজের চোখেই দেখেছি, ইস্পাতসম শক্ত ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে সাবেক একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা তৎকালীন সেতু মন্ত্রী আবুল হোসেনকে গ্রেপ্তারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন আজকের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, তিনি তা করবেন না বরং বিশ্বব্যাংক যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, সেটি নিয়ে তিনি লড়াই করবেন দেশের সম্মান বাঁচানোর জন্য। তখনকার দুদকের চেয়ারম্যান এবং আরেকজন কমিশনার এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন।
কিন্তু দুদকের তৎকালীন কমিশনার (তদন্ত ) হিসাবে দেশের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন এবং সংগ্রামী। একদিন প্রশ্নের ছলে তাকে প্রশ্ন করাহয়েছিল , এতটা সাহস নিয়ে কিভাবে কাজ করেন? তখন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বলেছিল সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। দেশের জন্য কাজ করতে হলে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে, দেশকে সোনার বাংলা করতে হলে, দেশকে শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ করতে হলে অবশ্যই বুকে সাহস থাকতে হবে। সাহস ছাড়া তুমি দেশকে ভালোবাসতে পারবে না, সাহস ছাড়া রাজনীতি করতে পারবে না।
মো. সাহাবুদ্দিন আজ বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। সকাল ১১টার দিকে বঙ্গভবনের ঐতিহাসিক দরবার হলে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তাঁকে (সাহাবুদ্দিন) রাষ্ট্রপতির পদে শপথ পাঠ করাবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ কয়েকশ বিশিষ্ট অতিথি এ অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন। এরপর নতুন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন শপথ নথিতে স্বাক্ষর করবেন।
রাষ্ট্রপতির সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানান, শপথ গ্রহণের পরপরই নতুন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন এবং রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ আনুষ্ঠানিকভাবে চেয়ার বদল করবেন । মুক্তিযোদ্ধা ও মাঠপর্যায়ের রাজনীতিবিদ মো. সাহাবুদ্দিন ২১তম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্থলাভিষিক্ত হবেন। রাষ্ট্রপতি হামিদ সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে ৪১ দিনসহ টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ১০ বছর ৪১ দিন অতিবাহিত করার পরে অবসরে যাচ্ছেন।
নতুন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানা ও ছেলে আরশাদ আদনান রনিসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, সংসদ সদস্য, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, কূটনীতিক, সম্পাদকসহ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং পদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করবেন।
এর আগে ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়াারি বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
ছাত্ররাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, আইন পেশা, বিচারকের দায়িত্ব, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের পর বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হয়েছেন মোহাম্মদ. সাহাবুদ্দিন। পৌঢ় খাওয়া এই মানুষটির দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা দেশকে আরো সমৃদ্ধ করবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালে পাবনা শহরের জুবিলি ট্যাঙ্কপাড়ায় (শিবরামপুর) জন্মগ্রহণ করেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। শহরের পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাসের পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। এরপর শুরু করেন রাজনীতি।
এরপর এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন করেন মো. সাহাবুদ্দিন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কলেজ জীবনে প্রবেশের আগেই ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাবনায় তার সাক্ষাৎ করেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন । ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এডওয়ার্ড কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি থেকে ছয় বছর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৭১ সালে পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ছাত্রলীগের সক্রিয় কাজের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পান।
১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকেও গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। কারামুক্তির পর পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি।
পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) পরীক্ষা দিয়ে বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুইবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন তিনি।
বিচারালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন শেষে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে ২০০৬ সালে অবসরে যান মো. সাহাবুদ্দিন। এরমধ্যে শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান পদেও তিনি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তখনকার বিচারক সাহাবুদ্দিন। বিচারক জীবনের ইতি টানার পর আবারও আইন পেশায় ফেরেন তিনি।
২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থাকার মধ্যে সরকার তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব দেয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়। সে সময়ের ‘হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের’ মতো ঘটনার পরবর্তীতে সরকার ক্ষমতায় গিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই কমিশনের প্রধান ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সাংবাদিকতা পেশাতেও যুক্ত ছিলেন সাহাবুদ্দিন। বিচার বিভাগে যোগ দেওয়ার আগে ১৯৮০ থেকে দুই বছর দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতা করেন । পাবনা প্রেস ক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতেও সদস্য ছিলেন তিনি। এছাড়া মহামান্য রাষ্ট্রপতি দুদকের কমিশনার হিসাবে অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন । মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলের বাবা। তার স্ত্রী রেবেকা সুলতানা যুগ্ম সচিব ছিলেন।
আজকের এই মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসাবে প্রাণভরে দোয়া কামনা করছি আপনার জন্য। আপনি শক্তিমান হয়ে উঠুন। মুজিব চেতনাকে সার্বজনীনভাবে ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী হোক আপনার ভূমিকা। আপনার হাত ধরে সকল প্রতিবন্ধকতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক। আগামীর দিন হোক আপনার, শুধুই আপনার।