রবিবার , ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১১ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

মু‌ন্সিগ‌ঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঘর

প্রকাশিত হয়েছে- সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
মু‌ন্সিগ‌ঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঘর
এসএম শাহাদাত বিশেষ প্রতিনিধি
মুন্সিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঘর নান্দনিক কারুকার্য খচিত। এসব ঘর তৈরীতে কাঠের সাথে লাল,সবুজ এবং হলুদ রংয়ের টিন ব্যবহার হচ্ছে।তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ঘরের টিনের নিচে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ ধরনের পেপার। দ্বিতল ঘরে উঠতে কাঠ দিয়ে তৈরি হচ্ছে পাকা ভবনের ন্যায় সিড়ি।একদিকে স্থানীয়দের কাছে কদর অন্যদিকে বাইরের জেলার মানুষের কাছে চাহিদা বাড়ায় জেলার ছয় উপজেলাতেই এখন বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন একতলা,দোতলা, চৌচালা, সাতচালা, টপ-বারান্দার টিন-কাঠের ঘর।ছয়টি উপজেলার হাট বাজারের পাশে পরিত্যক্ত ভিটায় বিক্রেতারা আগে থেকেই বানিয়ে রাখেন ঘর। ক্রেতারা এসব হাটে এসে পছন্দ করে নিয়ে যান ঘরগুলো। আবার অনেক ক্রেতা আগে থেকেও অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়ে যান এসব দৃষ্টিনন্দণ ঘর।জেলার বাইরের ক্রেতারা ঘর কেনার পর ওই ঘরগুলো বিভিন্ন জেলায় গিয়ে তুলে দিয়ে আসছেন এ জেলায় ঘর তৈরি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা। এসব ঘর তৈরির কাজে স্থানীয় শ্রমিকসহ দেশের বিভিন্ন জেলার শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন।সরেজমিনে মুন্সিগঞ্জ সদর, টঙ্গিবাড়ী, লৌহজং ও সিরাজদিখান উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে এসব উপজেলায় ঘরের চালে লাল,সবুজ, হলুদ টিন ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে শুধু সাদা টিন ব্যবহার করে ঘর তৈরি হতো। ক্রেতাদের চাহিদা ও দৃষ্টিনন্দন করার জন্যই ঘর তৈরিতে এসেছে পরিবর্তন।
ঘর বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলোতে তুলে রাখা হয়েছে সারি সারি কারু-কার্যময় টিন-কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর। এখানে দোতলা ঘর একটি ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। চারদিকে নদীবেষ্টিত মুন্সিগঞ্জ জেলা, নদী ভাঙনকবলিত অঞ্চল হওয়ায় এখানে টিন-কাঠের ঘরের কদর বেশি। ঘরগুলো স্থানান্তরযোগ্য হিসেবে তৈরি করায় ভাঙন দেখা দিলে সহজেই সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। এছাড়া প্রয়োজনে নগদ টাকায় বিক্রি করারও সুযোগ রয়েছে। তাই স্থানীয়দের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ ভবন তৈরি না করে টিনের ঘর করেন।ঘর তৈরির শ্রমিকরা জানান, আকৃতি ভেদে বিভিন্ন কাঠ দিয়ে একেকটি ঘরের তৈরিতে সময় লাগে ৭ থেকে ১ মাস সময় পর্যন্ত। তবে নান্দনিক দোতালা ৩ তলা ঘর তুলতে কয়েক মাস লেগে যায়।দোতালা ও তিনতলা ঘরে নকশা ও কারুকাজ বেশি হওয়া সময়ও অনেক বেশি  লেগে যায়। কাঠের নান্দনিক নকশার কারণে এ অঞ্চলে তৈরি ঘরগুলো অনেক বেশি কাঠের প্রয়োজন হয় । এককেটি সাধারণ ঘরে দুইশ থেকে চারশ কেবি কাঠ প্রয়োজন হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এক সময় বার্মার লোহা কাঠ, শাল কাঠ  ও সাদা টিন দিয়ে এই ঘর নির্মাণ হতো ঘর। কিন্তু এখন বার্মার লোহা কাঠ পাওয়া যায় না। তাই নাইজেরিয়া হতে আমদানি করা নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ, সেগুন কাঠ ও টিন দিয়ে অধিকাংশ ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জেলার দিঘিরপাড়, গৌড়দৌড়, বালিাগাওঁ, মুন্সিরহাট, শ্রীনগর বাজারসহ বিভিন্ন যায়গায় গড়ে উঠেছে এ সমস্ত কাঠ বিক্রির পাইকারী হাট।  লোহাকাঠ দিয়ে নির্মিত ঘরগুলো সাধারণত ৬০ বছর থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। হাটে একতলা ঘরগুলো ২-৮ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের  বিক্রি হয়। দোতালা তিন তালা ঘরগুলো ১২ থেকে ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে অনেকেই বাড়িতে কাঠমিস্ত্রি এনে ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২-৩ তলা প্রাসাদের মতো টিন ও কাঠ দিয়ে ঘর নির্মাণ করেন। সঙ্গে টিন ও প্লেন শিট দিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন নকশা। যা ঘরগুলোর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।রেডিমেড ঘর ব্যবসায়ীরা জানান, শুধু স্থানীয়রা নয়, আশপাশে বিভিন্ন জেলা থেকেও এসব ঘর কিনতে আসেন অনেকে। ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরিয়তপুর, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল এমনকি সিলেট, সুনামগঞ্জ, কক্সবাজারসহ দেশের অনেক জেলা হতে লোক এসে এসব ঘর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগনী ইউনিয়নের চূড়াইন গ্রাম,মহাকালী ইউপির বাগেশ্বর গ্রাম, সুয়াপাড়া গ্রাম, রামপালের ধলাগাঁও গ্রাম, টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বেতকা,কালিবাড়ি, বালিগাওঁ, কুণ্ডেরবাজার এলাকা, লৌহজংয়ের কলাবাগান কাঠপট্টি, সিরাজদিানের মালখানগর, কুচিয়ামোড়া, বালুচরসহ একাধিক স্থানে গড়ে উঠেছে ঘর বিক্রির হাট।লৌহজংয়ের কলাবাগান কাঠপট্টি এলাকার কাঠ মিস্ত্রি র‌ফিকুল ২৫ বছর ধরে ঘরের কাজ করছে। দেড় তলা থেকে দোতালা ঘর বানায়। তি‌নি ব‌লেন আগে ছিল বার্মার কাঠ এখন সে কাঠ ৫ হাজার টাকা কেবিও পাওয়া যায় না। এখন নাইজেরিয়ার কাঠ ১ হাজার ২০০ টাকা আগে পাওয়া গেলেও এখন ২ হাজার২ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা কেবি। এসব কাঠ অনেক ভালো। ৮০-৯০ বছরেও কিছু হয় না।  বিভিন্ন জেলার লোকজন এসে কিনে নিলে আমরা ট্রাক করে ঘর নিয়ে গিয়ে তুলে দিয়ে আসি। কাঠ বুঝে একটি দ্বোতালা ও ৩ তলা ঘর ৩০ লাখ ও ২০ লাখ ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় ।ঘর ব্যাবাসায়ী র‌হিমউদ্দীন বলেন, বর্তমানে ঘর কম চলছে। বাড়িতে পানি ওঠায় এ বছর বর্ষায় ঘর কম বিক্রি হয়েছে। এ জেলার পাশাপাশি কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বগুড়া,বরগুনা জেলাসহ পূর্ব অঞ্চলের জেলার লোকজন এসে কিনে নিয়ে যান। এখানে তৈরি ঘর সর্বোচ্চ  ১৫ লাখ টাকায় একটি ঘর বিক্রি হয়