জয়পুরহাট ক্ষেতলালে এমপিওর পর চাকরি গেল শিক্ষকের
মোঃ গোলাম মস্তফা তালুকদার রায়হান ( বিশেষ প্রতিনিধি )
জমজমাট ” ব্যাকডেট নিয়োগ বাণিজ্য !
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল খোশবদন জি, ইউ আলিম মাদ্রাসা এমপিও হওয়ার পর বিভিন্ন কৌশলে বর্তমান অধ্যক্ষ মোঃ একরামুল হকের নাটকীয় কারিশমায় নিয়োগ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে ।
এনিয়ে মাদ্রাসার পৌরনীতি প্রভাষক মোছাঃ অজিফা খান মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর মহাপরিচালকসহ ৮টি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন ৷
গত ৬ জুলাই ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটির ( আলিম স্তরে ) এম.পি.ও ভুক্ত হয় গত ৬ জুলাই নতুন করে ২ হাজার ৭১৬টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছেন সরকার। এরমধ্যে একটি ছিল ক্ষেতলাল খোশবদন জি, ইউ আলিম মাদ্রাসা। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আলিম শাখা শুরু থেকে যারা শিক্ষক-কর্মচারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন , এমপিওভুক্ত হওয়ার পর তাদের একটি অংশকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘ নয় মাসের অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল ।
ভুক্তভোগীরা বলছেন , এমপিওভুক্ত হওয়ার পর মাদ্রসার অধ্যক্ষ নিয়োগ বাণিজ্য করে হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। তাদের অভিযোগ, মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ মোঃ একরামুল হক তার মনোনীত সহযোগীদের নিয়ে এমপিওভুক্ত হওয়ার পর আলিম শাখায় শুরু থেকে চাকরিতে থাকা নিয়মিত ৩ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করেছেন। মোটা অংকের টাকা দিতে না পারায় এসব শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করে , তাদের পোস্টে নতুন শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়েছেন । শুধু তিনটি ‘প্রভাষক’ পদের নিয়োগে একক জনের কাছ থেকে ১৫ থেকে ১৭ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে চাকরি হারিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছেন চাকরিচ্যুত শিক্ষকেরা ।
ক্ষেতলাল খোশবদন জি, ইউ আলিম মাদ্রসায় শিক্ষকদের এমন অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে নানা অনিয়মের সত্যতা উঠে এসেছে।
নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন বেশি অর্থ প্রদানকারী শিক্ষককে। একইসঙ্গে অর্থ না দেওয়া বা দিতে না পারার কারণে নতুন তালিকায় বাদ পড়েছেন পুরাতন শিক্ষকরা ৷ মাদ্রাসার নিয়মিত শিক্ষক অজিফা খান , মোঃ সোহেল রানা ও মোঃ আনোয়ার হোসেনের পোস্টে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষক ৷
পৌরনীতি প্রভাষক মোছাঃ অজিফা খানের বিপরীতে অন্যজনকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে মাহফুজার রহমান চপলকে (ইংরেজি প্রভাষক) এবং মোঃ আবু নাছেরকে জীববিদ্যা প্রভাষক পদে নিয়োগ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে নতুন প্রভাষক মো. মাহফুজুর রহমান চপল ইংলিশে নিয়োগ পাওয়ার পূর্বে কর্মরত ছিলেন , মিনিগাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । ২০১৭ সাল থেকে ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন তিনি। গত ৫-১১-২০২৩ তারিখে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। উক্ত মামলার জয়, ১১৪৪/১/৫ স্মারকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই সহকারী শিক্ষককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয় ৷ তিনি গত তিন মাস যাবত ক্ষেতলাল খোশবদন আলিম শাখায় ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে ক্লাস নিচ্ছেন ৷
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফরহাদ হোসেন, জান্নাতি খাতুন, নাজমুল রেবেকা আক্তারসহ ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আলিম শিক্ষার্থীরা ইংলিশ প্রভাষক মাহফুজুর রহমান চপলকে চিনেন না এবং ক্লাস নিতেও তারা দেখেননি কোনদিন ।
মাদ্রাসায় নিজস্ব প্রচারপত্রে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের নাম আছে, যদিও বর্তমান অধ্যক্ষের দাবি তাদের কেউই এখানে চাকরি করতেন না এবং দু-একজনের অন্যত্র চাকরি হওয়াই চলে গেছেন৷
ক্ষেতলাল খোশবদন জি, ইউ আলিম মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির পর চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন , পৌরনীতি প্রভাষক অজিফা খান , ইংরেজি প্রভাষক মোঃ আনোয়ার হোসেন , জীববিদ্যা প্রভাষক মোঃ সোহেল রানা ।
অনুসন্ধান বলছে, নতুন নিয়োগ দেয়া শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আগের তারিখ দেখিয়ে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন চূড়ান্ত করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মাদ্রাসার ইংরেজি শিক্ষক মাহফুজার রহমান চপল ৷ তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকতা করেন ২০১৫ সালের আগের নিয়োগ ও ১১-১২ নিবন্ধন ব্যাকডেটে তার যোগদানের সময় বয়স দেখানো হয়েছে , তিনি ২০১৭ সাল থেকে (৫ নভেম্বর) ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হিসেবে সরকারি বেতন ভাতা উত্তোলন করেছেন ৷ কোনদিন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা না করলেও নতুন করে ওই মাদ্রাসায় ক্লাস নিতে দেখা যায় ৷ অথচ মাদ্রসা স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী , চাকরিপ্রার্থীরা প্রতিষ্ঠান চাহিদা মাফিক এনটিআরসির গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসির তত্ত্বাবধানে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়ে থাকে৷
চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের অভিযোগ , নতুন নিয়োগে শিক্ষকদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫ থেকে ১৭লাখ করে নিয়েছেন অধ্যক্ষ একরামুল হক । ব্যানবেইসের তালিকায়ও রয়েছে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের নাম ৷
উপজেলার ক্ষেতলাল খোশবদন জি, ইউ আলিম শাখা প্রতিষ্ঠার পর থেকে চাকরি করে আসা বেশ কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করে জানান , মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে দীর্ঘ দিন থেকে শিক্ষকতা করা শিক্ষকদের বিনা নোটিশে মৌখিকভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে , যা সম্পূর্ণ অনৈতিক । প্রতিটি নিয়োগের বিপরীতে ১৫ থেকে১৭ লাখ করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ একরামুল হক। এছাড়াও হঠাৎ চাকরিচ্যুত এসব শিক্ষককে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে মাদ্রসায় প্রবেশ করেত দেওয়া হয়নি । চাকরি হারিয়ে বর্তমানে কষ্টে জীবনযাপন করছেন চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা ।
এ নিয়ে চাকরিচ্যুত আরেক শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে সাংবাদিকদের জানান , মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আমাকে চাকরিচ্যুত করে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । এটি করেছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ একরামুল হক। টাকা ছাড়া তিনি কিছুই বুঝেন না , মাদ্রাসাটি তিনি অবৈধ বাণিজ্য কেন্দ্র বানিয়েছেন বলে অভিযোগ তার।
মাদ্রাসার ইংরেজি প্রভাষক আনোয়ার হোসেন বলেন , আমি দীর্ঘদিন ওই প্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে পরিশ্রম করেছি। এমপিও হওয়ার পর প্রিন্সিপাল আমার সাথে অমানুষিক নির্যাতন করেন। এখন পর্যন্ত আমি কোন রিজাইন লেটার দেয়নি এবং বেনবেইসে আমার নাম আছে । ২০২৩ সালে এনটিআরসির গণ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১জানুয়ারি ২০২৪ সালে বগুড়ার একটি প্রতিষ্ঠানে আমার ইন্ড্রিক্স হয়েছে ৷ আমার স্থলাভিত্তিক ইংরেজি প্রভাষক পদে একমাত্র এনটিআরসি নিয়োগ দিতে পারে। প্রিন্সিপাল ব্যাকডেটেড কাউকে নিয়োগ দিয়ে থাকলে এটি তদন্ত করা উচিত৷
অজিফা খান কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন , দীর্ঘ ১৩ টি বছর দুধের বাচ্চাকে নিয়ে বিনা বেতনে চাকরি করেছি। আমাকে অন্যায় ভাবে নির্যাতন করে চাকরিচুত্য করতেছে ৷ শেষ পর্যন্ত আমি আইনের সহায়তা গ্রহণ করবো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরো এক চাকরি প্রার্থীর বক্তব্যে উঠে আসে , যোগ্যতার বিষয়ে জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষের মনোনীত ব্যক্তি বলেন , আপনার যদি ২০১৫ সালের আগের নিয়োগ ও ১১-১২ নিবন্ধন হয় তবে চাকরি হবে। এই বিষয়ে কলেজ প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলেন। প্রিন্সিপাল কথা বলবে নয়তোবা অন্য কাউকে দিয়ে বলাবে। কেমন টাকা লাগতে পারে এমন বিষয়ে তিনি বলেন , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও করতে অনেক খরচ হয়। সবাই তো সেটা জানে। এখানে টাকারই খেলা। চাকরি পেতে হলে টাকার কোন বিকল্প নেই ।
মাদ্রাসার সভাপতির দাবি, তিনি শুধুমাত্র দায়িত্বেই ছিলেন। বাকিসব কাজ অধ্যক্ষ ও রেজাউল করতেন। এমনকি তিনি চিনতেন না মাদ্রাসার নিয়মিত শিক্ষকদের। তবে এমপিওভূক্তির পর ভুক্তভোগী শিক্ষকদের চাকরি না থাকার বিষয়টি তিনি জানতে পেরেছেন।
ক্ষেতলাল খোশবদন জি, ইউ আলিম মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ মো. একরামুল হক বলেন , এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট । এমপিওভুক্তির পর চাকরিচ্যুতির বিষয়ে তিনি বলেন , কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। এনটিআরসি’র গণবিজ্ঞপ্তি পর তারা চলে গেছেন। ফলে শূন্য পদেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে , কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি। বিল বেতন নেই তারা এমনিতেই চলে গেছেন। তাদের কোনো হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর নেই। এমপিও হওয়ার পর তারা অযৌক্তিক দাবি করছেন ৷
আর সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে মাদ্রাসার সভাপতি অ্যাডভোকেট এস এম মোরশেদ জানান , সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে কোন শিক্ষক নিয়োগ হয় নাই ৷ আমি যতদূর জানি ২০২১ এর পরিপত্র অনুযায়ী এনটিআরসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে থাকে। সাবেক সভাপতির মৃত্যুর পর সুকৌশলে ব্যাকডেটে এসব শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়েছেন বলে আমার কাছেও একটা অভিযোগ এসেছে ৷ আর আমি নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছুই জানিনা। অধ্যক্ষ একরামুল হক কিভাবে এসব করেছেন তিনি তার জবাব দিবেন। আমি এসবের মধ্যে নেই ৷
এ বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তের রাজশাহী বিভাগের পরিদর্শক লিপি রানী বলেন , এমপিওভুক্তির পর শিক্ষকদের নিয়োগ এবং আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। নিয়োগ বাণিজ্যসহ যেসব অনিয়মের কথা এসেছে তা নিয়ে যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে আমরা তা খতিয়ে দেখবো।