
মোঃ আজগর আলী, চট্টগ্রাম
বর্তমান বাংলাদেশে প্রচলিত সংসদীয় নির্বাচনে প্রথমে আসলে প্রথমে পাবে First Past the Post (FPTP) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে যেই প্রার্থী কোনো একটি আসনে সর্বাধিক ভোট পান, তিনিই বিজয়ী হিসেবে গণ্য হন even যদি তিনি মোট ভোটের মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ পেয়ে থাকেন। ফলে বাস্তবে এমন চিত্রও দেখা যায় একটি দল সারাদেশে মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে যায়, আর বাকি ৬০-৭০ শতাংশ ভোট কার্যত মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
গণতন্ত্রের অন্যতম মূলনীতি হলো প্রতিনিধিত্ব কিন্তু এই পদ্ধতিতে সেই প্রতিনিধিত্ব যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় না। এই অসম ও অনায্য পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে প্রয়োজন সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির (Proportional Representation – PR) প্রয়োগ। পিআর পদ্ধতির মূল ধারণা কী?
ধরা যাক, জাতীয় সংসদে আসন সংখ্যা ৩০০টি। যদি কোনো রাজনৈতিক দল সারাদেশে ১০% ভোট পায়, তাহলে সে দল পাবে ৩০টি আসন। অর্থাৎ, ১% ভোট মানেই ৩টি আসন। এটি একটি সরল, স্বচ্ছ এবং ন্যায্য গণনা পদ্ধতি। এতে একটি ভোটও বিফলে যায় না,প্রতিটি ভোট গণনায় পড়ে এবং সংসদ গঠনে সরাসরি ভূমিকা রাখে কেন প্রয়োজন এই পদ্ধতি? বাংলাদেশের নির্বাচনী বাস্তবতায় নির্বাচন আজ শুধুমাত্র ভোটের প্রতিযোগিতা নয় বরং কেন্দ্র দখলের প্রতিযোগিতা হয়ে উঠেছে। ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, ভোটারকে কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া, এসব কারণে জনগণের রায় বিকৃত হয়। কিন্তু PR পদ্ধতিতে এই ধরনের অনিয়ম প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে, কারণ আসন নির্ধারণ হয় সারাদেশের মোট ভোটের ভিত্তিতে একটি বা কয়েকটি কেন্দ্র দখল করে নির্বাচনের ফল পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, প্রার্থীতালিকা আগেই নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া থাকে ফলে ব্যক্তি নির্ভরতা কমে যায়, দলীয় তালিকাভিত্তিক মনোনয়নে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রভাব ও অর্থের ভূমিকা হ্রাস পায়।
পিআর পদ্ধতির প্রধান সুবিধাসমূহ: ভোটের অপচয় নেই: বর্তমান ব্যবস্থায় হেরে যাওয়া প্রার্থীর সকল ভোট নিষ্ফল হয়ে যায়। কিন্তু PR পদ্ধতিতে প্রত্যেক ভোটই দলীয় ভাণ্ডারে যুক্ত হয় এবং আসন নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণ সহজতর হয়: যেহেতু কেন্দ্রভিত্তিক নয়, বরং সার্বিক জাতীয় ভোটই গৃহীত হয় প্রবাসীদের জন্য ই-ভোটিং বা ডাকযোগে ভোটদানে সুবিধা তৈরি হয়।
ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের প্রয়োজন ফুরায়: স্থানীয় কেন্দ্র দখল করেও জাতীয় ফলাফলে তেমন প্রভাব ফেলা যায় না।
ছোট দল ও নতুন রাজনৈতিক শক্তির সুযোগ সৃষ্টি: জাতীয়ভাবে অল্প কিছু ভোট পেয়েও একটি দল আসন পেতে পারে। এতে গণতন্ত্রে নীতিগত বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য সৃষ্টি হয়।
একদলীয় আধিপত্য হ্রাস: একটি দল যদি ৩৫% ভোট পায়, তাহলে তার প্রাপ্য হবে সর্বোচ্চ ১০৫টি আসন। এখনকার মতো ২৫০টির বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। এতে রাজনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা পায়। রাষ্ট্রপতির ভূমিকা শক্তিশালী হলে শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য আনা সম্ভব: PR পদ্ধতির পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী শাসন কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব।
বিশ্বজুড়ে PR পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশ, বিশেষ করে ইউরোপের জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ইসরায়েল প্রমুখ রাষ্ট্রে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি কার্যকরভাবে অনুসৃত হচ্ছে। এসব দেশে নির্বাচন হয় শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক এবং অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল। ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হয় ফলে নীতির বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য বজায় থাকে।
বাংলাদেশে PR চালু করতে করণীয় সংবিধান সংশোধন করে PR পদ্ধতির আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতা আরও দৃঢ় করতে হবে। দলগুলোর জন্য তালিকাভিত্তিক মনোনয়ন প্রক্রিয়া প্রণয়ন করতে হবে। প্রবাসীদের জন্য ই-ভোটিং বা পোস্টাল ভোটিংয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সংসদের মোট সদস্যসংখ্যা অপরিবর্তিত রেখেই পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রতিবন্ধকতা ও করণীয় প্রচলিত বড় দলগুলো, যারা বিদ্যমান পদ্ধতিতে সুবিধাভোগী, তারা স্বাভাবিকভাবেই এই পদ্ধতির পরিবর্তনে আগ্রহ দেখাবে না। কিন্তু জনগণের চাপ, সচেতন নাগরিক সমাজ, মিডিয়া এবং তরুণ প্রজন্মই হতে পারে এই কাঠামোগত পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণির সক্রিয় প্রচেষ্টায় এই দাবি সমাজে মূলধারায় প্রবেশ করতে পারে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ প্রশ্নবিদ্ধ, অসহিষ্ণু ও বিভক্ত। প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার যার ভিত্তি হতে পারে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি ভোটের মূল্য রয়েছে, প্রতিটি দলের জন্য ন্যায্য সুযোগ থাকে, এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া হয় স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। প্রশ্ন হলো আমরা কি সত্যিকারের গণতন্ত্র চাই, না কি শুধু নির্বাচনের নামে প্রহসনেই সন্তুষ্ট থাকবো?